অবহেলিতই থেকে গেলেন দেশের প্রথম বাঁহাতি স্পিনার রামচাঁদ
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/08/16/photo-1502895453.jpg)
স্কুল শিক্ষক বাবা চাইতেন আর দশজনের মতো ছেলেটা লেখাপড়া করুক। ভবিষ্যতে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে টাকা কামাক। তবে ছেলের ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। সুযোগ পেলেই দৌঁড় খেলার মাঠে। ক্রিকেটটা তখনও বাংলাদেশে ততটা জনপ্রিয় নয়। তাতে কি! সুযোগ পেলেই বল-ব্যাট হাতে নেমে পড়তেন। ব্যাটিংটা খুব ভালো না পারলেও বলটা দারুণ করতেন। বাঁহাতি পেসারদের ক্ষেত্রে প্রকৃতিগতভাবে পাওয়া সুইংটা ছিল তাঁর মূল অস্ত্র। সমবয়সীরা তো দূরের কথা, বড়রাও তাঁর বলের সামনে টিকতে পারতেন না। এরপর পেস বাদ দিয়ে শুরু করলেন স্পিন। এখানে আরও বেশি সফল তিনি। উপমহাদেশের চিরাচরিত স্লো উইকেটে হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য। অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভা, অরুণ লালের মতো ব্যাটসম্যানরা তাঁর বলে খাবি খেয়েছেন। অথচ, দেশনন্দিত সেই ক্রিকেটাকে চেনে না অনেকেই। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রথম বাঁহাতি স্পিনার রামচাঁদ গোয়ালার কথা।
শুরুটা স্কুল ক্রিকেট দিয়ে। ময়মনসিংহের পাড়ার ক্রিকেটেও খেলেছেন অনেকদিন। এখানেই পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হয়ে গড়ে ওঠেন রামচাঁদ। এরপর ভিক্টোরিয়ার হয়ে ১৯৬২ ঢাকা লিগে অভিষেক হয়। ততদিনে অবশ্য পুরোদুস্তুর স্পিনার হয়ে গেছেন তিনি। সৈয়দ আশরাফুল হক, রকিবুল হক, আতহার আলী, ঈসমাইল গুলরা তখন ঢাকার ক্রিকেটে বেশ বড় নাম। এরপর পাঁচ বছরের মতো টানা খেলেছেন ভিক্টোরিয়ায়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক দলে ডাক পেয়ে যান তিনি। দলের হয়ে অনুশীলন করলেও মাঠে নামা হয়নি রামচাঁদের। এরপর কয়েক বছর ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন তিনি।
দেশ স্বাধীনের পর আবার ফিরলেন মাঠে। এবার যাত্রাটা শুরু হলো টাউন ক্লাবের হয়ে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ভিক্টোরিয়া, আর রামচাঁদ সেই ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষেই নেন ৭ উইকেট। সেই ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের নজরে আসেন রামচাঁদ। সে বছর ময়মনসিংহেও তার বোলিংয়ের কাছে হেরে যায় শেষ কামালের দল। কামালই তাঁকে আবাহনীতে খেলার প্রস্তাব দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাত্রীতে শেখ কামালসহ বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার শহীদ হলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে রামচাঁদের আবাহনীতে খেলার স্বপ্ন। পরে অবশ্য ক্লাব কতৃপক্ষ রামচাঁদকে দলে ভেড়ায়। এরপর ১৫ বছর আবাহনীর হয়ে খেলেন তিনি। একটা সময় তো তার নামটা রামচাঁদ গোয়ালা থেকে আবাহনী গোয়ালা পড়ে যায়! ক্লাব কৃতপক্ষ তাঁর জন্য আলাদা কক্ষেরও বরাদ্দ রেখেছিলেন।
জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন রামচাঁদ। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে যান পশ্চিমবঙ্গের বিপক্ষে। সেবার কালিঘাট, চন্দননগর, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ অনূর্ধ্ব-২২ দলকে হারায় বাংলাদেশ। ৫ ম্যাচের সিরিজটা ৪-১ ব্যবধানে জিতে নেয় রকিবুল হাসান, গাজী আশরাফ লিপু, মিনহাজুল আবেদীন নান্নুদের দল। সিরিজটাতে দারুণ বল করেন রামচাঁদ। শেষ ম্যাচে অরুণ লালের মতো ব্যাটসম্যানও তাঁর বল খেলতে গিয়ে দারুণ সমস্যায় পড়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনদিনের ম্যাচে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে রানাতুঙ্গাকে বোল্ড করেছিলেন রামচাঁদ। স্পিনে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। ঢাকার লিগেও একাধিকবার রানাতুঙ্গা, ডি সিলভাদের মতো ব্যাটসম্যানকে পরাভূত করেছেন তিনি।
রামচাঁদ গোয়ালার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল বলটাকে দারুণভাবে টার্ন করাতে পারতেন। বলের ফ্লাইটে অসংখ্য ব্যাটসম্যানকে ধোঁকা খাইয়েছেন। ছয় বার ঢাকার লিগে সর্বাধিক উইকেট শিকারী বোলার হয়েছেন রামচাঁদ। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ যখন প্রথম আর্ন্তজাতিক ম্যাচে মাঠে নামেন রামচাঁদ তখন ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে। বয়সটা প্রায় ৪৫! গাজী আশরাফ, এনামুল হক মনিরা তখন বেশ প্রতিষ্ঠিত স্পিনার। সেই কারণেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে দেশের হয়ে নামা হয়নি রামচাঁদের। তাতে অবশ্য তাঁর বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। ১৯৯৩ সালে যখন ক্যারিয়ারের ইতি টানেন রামচাঁদের বয়স তখন ৫৩!
দেশের ক্রিকেট আজ এগিয়ে গেছে সহস্র যোজন দূরে। সাকিব-তাইজুলরা গোটা বিশ্ব দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ ময়মনসিংহের ব্রাহ্মণপল্লীতে অভাব অনটনের মধ্যে জীবনের শেষ দিনগুলোর পার করছেন তিনি। ক্রিকেটার, সতীর্থ, ক্লাব, বোর্ডসহ কেউ খবর নেয় না কিবদন্তিতুল্য এই স্পিনারের। বিশেষ সংখ্যা বা পুরনো দিনের ক্রিকেট নিয়ে লেখার প্রয়োজন হলে দুই-একজন সাংবাদিক খোঁজ নেন রামচাঁদের। সম্মাননা আর কিছু টাকা দিয়েই দায় সেরে যায় তাদের।
এতোকিছুর পরও কোন আক্ষেপ নেই অকৃতদার এই মানুষটির। দেয়ালে টানানো কিছু ছবি ও ট্রফির দিকে তাকিয়েই দিন কাটছে তাঁর। সবার অলক্ষে বেঁচে থাকা মানুষটির প্রিয় বন্ধু তাঁর ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা। বাংলাদেশের খেলা হলে এখনও টেলিভিশনের সামনে বসতে ভোলেন না তিনি। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের মাঝে দেখতে পা নিজের ছায়া। সারাটা জীবন মাঠে কাটানো এই মানুষটি এখন শান্তিতে দুচোখ বোজার অপেক্ষায় রয়েছেন।