ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ‘দ্য টাইগার’

Looks like you've blocked notifications!

ব্যাট করতেন তিনি অনেকটা হেঁটে হেঁটে। যে কারণে শিবনারায়ণ চন্দরপলকে তুলনা করা হতো ‘কাঁকড়ার’ সঙ্গে। আবার লম্বা ইনিংস খেলার স্বভাবজাত দক্ষতার জন্য কেউ কেউ তুলনা করতেন শামুকের সঙ্গে। ক্রিকেট বিশ্ব যখন লারা, শচীনদের অসাধারণ টেকনিকে বুঁদ তখন চন্দরপল দেখিয়েছেন চিরাচরিত ব্যাকরণের বাইরেও ক্রিকেটে সাফল্যের পথ আছে। নিজস্ব ঢং আর দক্ষতায় রাঙিয়ে গেছেন ক্রিকেটকে। লারা পরবর্তী যুগে তাঁর চেয়ে বেশি সাফল্য পায়নি আর কোনো ক্যাবিবীয় ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটর অতন্দ্র প্রহরী বলা হয় এই ব্যাটসম্যানকে।

১৯৯৪ সালের মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গায়ানা টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। ১৬৪ ম্যাচে ৫১.৩৭ গড়ে তার রান ১১ হাজার ৮৬৭। টেস্টের ইতিহাসে তাঁর চেয়ে বেশি রান আছে ছয়জন ব্যাটসম্যানের। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল ব্রায়ান লারা আছেন তাঁর উপরে। লারার চেয়ে মাত্র ৮৬ রান কম চন্দরপলের। ৩০টি শতক আর ৬৬ অর্ধশতক এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। তবে অপরাজিত সেঞ্চুরির তালিকায় তিনিই সবার উপরে। ১৭টি অপরাজিত সেঞ্চুরি আছে চন্দরপলের ঝুলিতে। পরের নামটি শচীন টেন্ডুলকারের, ১৬টি অপরাজিত সেঞ্চুরি। ২৬৮টি ওয়ানডেতে ৪১.৬০ গড়ে ৮৭৭৮ রান। ১১টি শতক এবং ৫৯টি অর্ধশতক। এছাড়া ২২টি টি-টোয়েন্টিতে করেছেন ৩৪৩ রান। ৩৬৫ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে করেছেন ২৬ হাজার ৭০১ রান। লিস্ট 'এ'র ৪১৫ ম্যাচে আছে ১৩ হাজার ২৫২ রান। লেগস্পিনে নিয়েছেন ১৩টি আন্তর্জাতিক উইকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় চন্দরপলের অবস্থান নবম। টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-২০ মিলিয়ে তার রান ২০ হাজার ৯৮৮। সবার উপরে থাকা শচীনের রান ৩৪ হাজার ৩৫৭।

দুইবার আউটের মাঝে টানা ১ হাজার ৫১৩ মিনিট ব্যাট করার রেকর্ডটি এ বাঁহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের। ক্রিকেট ইতিহাসে আউট না হয়ে টানা ১ হাজার (১০৫১) বল মোকাবেলা করা একমাত্র ব্যাটসম্যানও তিনিই।

নিয়মিত রান করে গেলেও ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে লারার ছায়ার নিচেই থাকতে হয়। লারার বিদায়ের পর ক্যারিবীয় ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় আস্থা হয়ে ওঠেন। অবশ্য প্রথম ৫৩ টেস্টে তার সেঞ্চুরি ছিল মাত্র ২টি এরপর থেকে ব্যাটিংয়ে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেন। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ দুই বলে যখন ১০ রানের দরকার তখন চামিন্দা ভাসের বলে চার এবং ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে জেতান। নিভৃতে থেকে প্রয়োজনের সময় হামলে পড়া স্বভাবের জন্য সাবেক ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তী রোহান কানহাই তার নাম দিয়েছিলেন 'দা টাইগার'। মাঠে সবসময় শান্ত থাকলেও দলের দুঃসময়ে প্রতিপক্ষকে সামাল পাল্টা আক্রমণের কৌশলটা জানতেন খুব ভালোভাবে জানতেন চন্দরপল।

দুই চোখের নিচের লাগানো স্টিকারকে নিজের ট্রেডমার্ক বানিয়ে ফেলেছিলেন। এটাকে তাঁর ফ্যাশনের অংশ মনে হলেও আসলে তা নয়, মূলত তীব্র আলো থেকে দৃষ্টিকে বাঁচাতে এটি লাগাতেন যাতে আলোর বিপরীতে বল ভালোভাবে দেখতে পারেন। বিষয়টি নাকি স্কুল জীবনেই আবিষ্কার করেছিলেন। একটা সময় এই স্টিকার এতোটাই পরিচিতি আর জনপ্রিয়তা পায় যে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি এটির স্পন্সরশিপ নিয়ে নেয়।

২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ২০৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন পরে ২০১২ সালে অবশ্য মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে আবারো ২০৩ রান করেন। ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দেয়ার জন্য এক বছরের মাথায় অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৪টি টেস্ট এবং ১৬ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৮ সালে 'উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার' এবং আইসিসি প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন।

২০১৫ সালের মার্চের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট দলে সুযোগ মেলেনি তাঁর। আগের বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাজে পারফরম্যান্সের জন্য ৪০ বছরের চন্দরপলকে আর বিবেচনায় আনেননি প্রধান নির্বাচক ক্লাইভ লয়েড। যদিও আশায় ছিলেন আবারো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর। তা আর হলো না, হলো না লারাকে টপকে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ রানের মালিক হওয়া। অবশেষে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বোর্ডকে জানিয়ে দেন, আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন না।

চন্দরপলকে ক্রিকেট মনে রাখবে লড়াকু এক ব্যাটসম্যান হিসেবে। দারুণ বিপর্যয়ে যিনি ক্রিজে থাকলে বেঁচে থাকত দলের আশাটাও। ১৯৭৪ সালে গায়ানায় জন্ম নেয়া এ কিংবদন্তীর আজ (১৬ আগস্ট) ৪৩তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন 'টাইগার'।