ইমরান খান : ক্রিকেট কিংবদন্তি থেকে প্রধানমন্ত্রী

Looks like you've blocked notifications!

ছেলেবেলার শান্ত-লাজুক ছেলে, যৌবনের উজ্জ্বল ক্রিকেট তারকা, পরে সমাজসেবক থেকে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী। দুর্দান্ত বৈচিত্র্যময় জীবন পাকিস্তানের নব্যনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ খান নিয়াজীর। শুধু পেশাগত জীবন নয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ তাঁর বিবাহিত-ব্যক্তিগত জীবনও।

আজ  শনিবার পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন তাঁর জীবনীভিত্তিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্যে লেখাটি তুলে ধরা হলো :

পাঞ্জাবের একটি পশতুন স্বচ্ছল পরিবারে ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর জন্ম হয় ইমরান খানের। পরে তাঁর পরিবার লাহোরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। আর তাই, যৌবনের বেশিরভাগ সময় লাহোরেই কাটে তাঁর।

বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান এবং চার বোনের একমাত্র ভাই হিসেবে ইমরানকে প্রায়ই অহংকারী বলে ডাকা হতো। যদিও তিনি কখনোই বিষয়টি স্বীকার করেননি। তবে, ছেলেবেলায় খুবই শান্ত ও লাজুক বলে পরিচিত ছিলেন ইমরান।

ইমরানের পরিবারে এক ধরনের ক্রিকেটপ্রীতি ছিল। তাঁর মামাতো ভাই জাভেদ বারকি এবং মাজিদ খান ক্রিকেট খেলতেন। যার ফলে, স্কুলে থাকতেই তাঁর ভেতরে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ইমরান খেলতে শুরু করেন। আর মামাতো ভাইদের উৎসাহেই তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এবং পাকিস্তানের হয়ে খেলতে শুরু করেন।

ইমরান খান লাহোরের অ্যাটকিনসন কলেজ এবং ক্যাথেড্রাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি অরচেস্টারের রয়েল গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের প্রধান ছিলেন। সে সময় তিনি ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন।

৭৫টি টেস্ট ম্যাচ খেলা ইমরান অলরাউন্ডারের খেতাব পান এবং ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথামের পর বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড গড়েন। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ চূড়ায় যান ১৯৯২ সালে, যখন তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তান ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতল, সেবারই তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানান।

এ ছাড়া নারীদের মধ্যে এবং নাইট ক্লাবগুলোতে ঘন ঘন যাওয়ার কারণে ইমরান বেশ আলোচিত ছিলেন।

লেখক ক্রিস্টোফার সেন্ডফোর্ড তাঁর বইতে ইমরান খান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পরিচিত সব নাইট ক্লাবেই ইমরান যেতেন। তিনি নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং তাদের সঙ্গ পেতেও পছন্দ করতেন। আর এ জন্য তিনি বেশ সুপরিচিত ছিলেন। তিনি অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় খেতেন না। তবে, বন্ধুদের সঙ্গে পান করতে তাঁর কোনো অসুবিধাও ছিল না।’

বিবাহিত জীবন : ৪১ বছর বয়সে ইমরানের ‘প্লেবয়’ পরিচয় ফুটে ওঠে। ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ জেমাইমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুটি ছেলেও হয়। ছেলেদের নাম সোলাইমান ও কাসিম।

তবে, নয় বছর পর তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ইমরান খান তাঁর বইয়ে বলেছেন, ‘আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদের ছয় মাসের মধ্যে এবং তারপরের বছরগুলো আমার জীবনের সবচাইতে কঠিন সময় ছিল। জেমাইমা পাকিস্তানে আমার সঙ্গে থাকতে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমার রাজনৈতিক জীবন তাঁর জন্য এটা কঠিন করে তুলছিল।’ তাঁর ছেলেরা এখন ইংল্যান্ডে মায়ের সঙ্গে থাকে।

এরপর ২০১৫ সালে একটি সাদাসিধে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো ইমরান বিয়ে করেন। এবার বিয়ে করেন সাংবাদিক রেহাম খানকে। তবে, এ সম্পর্কটা মাত্র নয় মাস টেকে। পরবর্তী সময়ে ইমরান তাঁর এই বিয়েকে ‘জীবনের সবচাইতে বড় ভুল’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

সবশেষে ২০১৮ সালে তৃতীবারের মতো ইমরান খান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এবার বিয়ে করেন বুশরা বিবি নামের এক আধ্যাত্মিক নারীকে, যার কাছে তিনি প্রায় দুই বছর যাতায়াত করেন।

ক্রিকেটার থাকাকালীন বেশ কয়েকবার ইমরান রাজনীতি করার প্রস্তাব পান। কিন্তু সে সময় তিনি সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। জানা যায়, ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সেনাশাসক জিয়াউল হক ইমরানকে পাকিস্তান মুসলিগ লিগে অংশ নিতে প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ইমরান। এরপর নওয়াজ শরিফও তাঁকে অংশ নিতে প্রস্তাব জানান। সেবারও তিনি বারণ করে দেন। ১৯৯২ সালে এক অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরিফ বলেন, ‘অনেক বছর আগে ইমরানকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না করে। কেন তা আমি জানি না। সে প্রস্তাব এখনো রয়েছে আমার পক্ষ থেকে।’

যাই হোক, ১৯৮৭ সালে ক্রিকেট থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দিলেও, জিয়াউল হকের অনুরোধে তিনি আবারও খেলেন। কিন্তু ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের পর তিনি সত্যিই অব্যাহতি নেন।

আর তার পরই তিনি একজন সমাজসেবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। দরিদ্র মানুষের বিনাপয়সায় ক্যানসারের চিকিৎসায় তিনি ক্যাম্পেইন করেন।

অবশেষে ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল ইমরান খান নিজের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ (পিটিআই) গড়ে তোলেন। কিন্তু, ১৯৯৭ সালে প্রথম নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দলটি পরাজিত হয়। পরের বছরগুলোতে ইমরান খান কোনো কথাই শোনেন না এমন অভিযোগে অনেক রাজনীতিক দলটি থেকে সরে দাঁড়ান।

২০১১ সালে আবারও ইমরান খানকে রাজনীতিতে সরব হতে দেখা যায়। তবে, ব্যাপক প্রচারণার পরেও ২০১৩ সালের নির্বাচনে ইমরানের দল আবারও পরাজিত হয়।

পরবর্তী চার বছর ইমরান ও তাঁর দল পিটিআই  সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে।

অবশেষে এ বছর নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। পরে নিজের বক্তব্যে ইমরান খান বলেন, ‘আমি কেন রাজনীতিতে এসেছি, বিষয়টি আমি পরিষ্কার করতে চাই। রাজনীতি হয়তো আমাকে কিছু দেবে না। আমার নেতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেমন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমি পাকিস্তানকে তেমন দেশ করে গড়ে তুলতে চাই।’