সাক্ষাৎকার

‘এত প্রাপ্তির মাঝে মাকে খুঁজে পাই’

Looks like you've blocked notifications!

পরপর দুটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশকে জিতিয়ে দেশের ফুটবলের সব আলো কেড়ে নিয়েছেন তরুণ মিডফিল্ডার মোহাম্মদ রবিউল হাসান। তাঁর গোলেই লাওসকে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। শুধু জাতীয় দলেই নন, ক্লাব ফুটবলেও তাঁর চাহিদা আকাশচুম্বী। দলবদলে বাজারে পারিশ্রমিক ৫০ লাখ টাকা!

সদ্য শেষ হওয়া প্রিমিয়ার লিগে সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছেন রবিউল। এত প্রাপ্তির মাঝেও আছে শূন্যতা। চার বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন। বাবা আর বড় ভাইয়ের ছায়ায় হয়ে উঠেছেন  ফুটবলার। এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রবিউল হাসান জানিয়েছেন, মাকে হারিয়ে এই অবস্থানে আসার পেছনের গল্প। জানিয়েছেন দেশের ফুটবলে সুদিন ফেরানোর স্বপ্নের কথা।

প্রশ্ন : আপনার দল পাঁচে থেকে লিগ শেষ করলেও সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন, অনুভূতি কেমন?

রবিউল হাসান : আসলে এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। আমার স্বপ্ন ছিল লিগের সেরা ফুটবলার হওয়া। তবে সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় যে হয়েছি, এটা আমাকে সামনের দিকে যাওয়ার উৎসাহ জোগাবে।

প্রশ্ন : আত্মবিশ্বাস কী আগে থেকেই ছিল?

রবিউল হাসান : আসলে আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করেছি। লিগ শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চাই সেটার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। সেটা বিবেচনা করে আমি বেশি কাজ করেছি, সতীর্থরা যতক্ষণ অনুশীলন করতেন, আমি তাঁদের চেয়ে বেশি সময় করতাম। সময়ের কাজ সময়ে করতাম। এগুলোই কাজে দিয়েছে। আত্মবিশ্বাস ছিল, লিগে আমি যেকোনো কিছু হব।

প্রশ্ন : সব ম্যাচে খেলতে পারলে লিগের সেরা খেলোয়াড় হতে পারতেন?

রবিউল হাসান : লক্ষ্য ছুঁতে পারতাম কি না জানি না, আবার হতেও পারতাম। কারণ আমি চোটের কারণে ১১ ম্যাচের মতো মাঠের বাইরে ছিলাম। যদি সব ম্যাচ খেলতে পারতাম তাহলে আমার অবস্থান আরো ভালো হতো।

প্রশ্ন : আপনার গোলে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ওঠে বাংলাদেশ, সে ম্যাচই কি আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট?

রবিউল হাসান : আমার জীবনের দুটি টার্নিং পয়েন্টের একটি হলো কম্বোডিয়ার বিপক্ষে, আরেকটি  হলো লাওসের বিপক্ষে গোল করে দলকে জেতানো। এর মধ্যে লাওসের বিপক্ষে আমার গোলে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলার যোগত্য অর্জন করে বাংলাদেশ। এফসি কাপে খেলাও নিশ্চিত হয়। এটা আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। কারণ সে ম্যাচে  যদি আমরা হেরে যেতাম তাহলে সব ধরনের ফুটবল থেকে আমরা তিন বছরের জন্য পিছিয়ে যেতাম। সে কারণে লাওসের বিপক্ষে ম্যাচটি আমার জন্য স্মরণীয়।

প্রশ্ন : এই সাফল্যের পেছনের গল্প কেমন ছিল?

রবিউল হাসান : ২০০৩ সালে চার বছর বয়সে আমার মা মারা যান। মাকে ছাড়া এতটুকু আসা অনেক কঠিন ছিল। যদিও বড়ভাই-বাবা আমাকে আগলে রাখেন। কখনো মায়ের অনুপস্থিতি বুঝতে দিতেন না। টাঙ্গাইল কলেজ মাঠে যখন খেলতাম, তখন বর্তমান নারী দলের কোচ ছোটন স্যারের ভাই গোলাম রায়হান স্যার আমাকে দেখেন। আমার খেলা দেখে উনি জিজ্ঞেস করেন, আমি ফুটবল খেলতে চাই কি না। সেখান থেকেই শুরু। উনি বাবাকে বলে আমাকে নিয়ে আসেন। ২০০৯ সালে শুরু হয় প্রথম প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলা। এরপর দেশের হয়ে আফ্রিকা গেলাম। সেখানে খেলে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলাম। তারপর অনূর্ধ্ব-১৯ দল ও অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পেলাম।

প্রশ্ন : বসুন্ধরা কিংস আপনাকে বড় অঙ্কের পারিশ্রমিকে নিতে যাচ্ছে, ক্লাবটির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন?

রবিউল হাসান : আসলে দলবদলের বিষয়টি এখনো শতভাগ নিশ্চিত নয়। ৮০ ভাগ নিশ্চিত। যদি সত্যিই যায় তাহলে অবশ্যই আমি নিজের সেরাটা দিয়ে দলের সাফল্য এনে দিতে চেষ্টা করব। শুধু বসুন্ধরা কিংসই নয়, যেখানেই খেলি, চেষ্টা করব নিজেকে মেলে ধরার।

প্রশ্ন : দেশের ফুটবলের বর্তমান অবস্থা দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত কি না?

রবিউল হাসান : ভুটানের সঙ্গে হারার পর দুই বছর আমাদের দেশ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারেনি। যেটা আমাদের ফুটবলের একটা দুর্দিন ছিল। ধীরে ধীরে সে অবস্থা থেকে আমরা বের হচ্ছি। ১৯৪ থেকে ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৮২তে এসেছি। আশা করি আমাদের ফুটবলেও সুদিন ফিরবে। আমরা চাই সেটা আমাদের দ্বারাই হোক। আমরা চেষ্টা করব দেশের ফুটবলকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত না থাকতে পারলেও নতুন প্রজন্মকে সে পথ দেখিয়ে যাব।

প্রশ্ন : ফুটবলে কাকে অনুসরণ করেন?

রবিউল হাসান : আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমি রিয়ালের সাবেক অধিনায়ক হোসে মারিয়া গুতিকে অনুসরণ করতাম। তাঁর খেলার ধরন থেকে শুরু করে সবকিছু ভালো লাগত আমার।

প্রশ্ন : জাতীয় দলে ভূমিকা মিডফিল্ডার, কিন্তু আপনাকে সব পজিশনেই লড়তে দেখা যায়, আবার ক্লাব দলের অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। সব ম্যানেজ করা কতটা কঠিন?

রবিউল হাসান : আসলে সবকিছুর মূলে হয়েছে পরিশ্রম। গোল করতে সবারই ভালো লাগে। আমারও তাই। কিন্তু সতীর্থদের দিয়ে গোল করাতে বেশি আনন্দ পাই। কখনো আক্রমণে থেকে গোল করতে চেষ্টা করি। আবার ডিফেন্ডিংয়ে এসে দলকে আগলে রাখতে চেষ্টা করি। সব মিলিয়ে বলতে পারেন, এটাই আমার খেলার ধরন। চেষ্টা করি সব বিভাগেই অবদান রাখতে।

প্রশ্ন : এ অবস্থায় এসে মাকে কতটা মিস করেন?

রবিউল হাসান : সব মা-বাবারই সন্তানের প্রতি চাওয়া থাকে। হয়তো আমার মায়েরও ছিল। আমি এখন দেশসেরা উদীয়মান ফুটবলার, জাতীয় দলের জার্সিতে খেলছি, আমার গোলে দেশ সাফল্য পাচ্ছে, বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এসব যদি মা দেখে যেতে পারতেন তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি তিনি হতেন। অনেক বেশি মিস করি তাঁকে। তবে বিশ্বাস করি, মা তো সব কিছু দেখতে পারছেন। হয়তো আমার সাফল্য উনি দেখতে পাচ্ছেন, খুশি হচ্ছেন এবং সবসময় আমার পাশে আছেন। সব সফলতার মাঝে আমি মাকে খুঁজে পাই।