অলিম্পিকে যাঁদের কোনো দেশ নেই!

Looks like you've blocked notifications!

তাঁদের দেশ থেকেও নেই। যুদ্ধবিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য দেশে। পরিচয় পেয়েছেন শরণার্থী হিসেবে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকাটাই তাঁদের জন্য এক বিরাট সংগ্রাম। তবে এত কিছুর পরও হার মানেননি অদম্য কিছু মানুষ। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর অলিম্পিকে অংশ নিয়ে ইতিহাস গড়েছেন শরণার্থী এই ক্রীড়াবিদরা।

অলিম্পিকে প্রায় সব খেলোয়াড়ই অংশ নেন নিজ নিজ দেশের পতাকাতলে। কিন্তু এবারের রিও অলিম্পিক দেখছে এমন ১০ খেলোয়াড়কে, যাঁদের কোনো দেশ নেই। তাঁরা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন শরণার্থী হিসেবে। অলিম্পিকে এর আগে স্বতন্ত্র প্রতিযোগী দেখা গেলেও কোনো শরণার্থী দল দেখা গেল এবারই প্রথমবারের মতো। শরণার্থী অলিম্পিক দলের এই ১০ সদস্যের গল্প যেমন বেদনা জাগাবে, তেমনই জোগাবে অনুপ্রেরণা। পদক জয়ের সাফল্য পান আর না পান, কোনো পরিস্থিতিতে হার না মানার শিক্ষাই তাঁরা দিয়ে যাচ্ছেন অলিম্পিকে অংশ নিয়ে। দেখে নেওয়া যাক এই অদম্য শরণার্থী অলিম্পিয়ানরা কবে কোন ইভেন্টে অংশ নেবেন।

রামি আনিস (সাঁতার)

২৫ বছর বয়সী রামি আনিস এসেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে। ২০১৫ সালে জীবন বাজি রেখে নৌকায় করে পাড়ি দিয়েছেন ভূমধ্যসাগর। প্রথমে তুরস্ক ও পরে জায়গা পেয়েছেন বেলজিয়ামে। সেখান থেকেই এসেছেন অলিম্পিকে। এখন ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরটা স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে আনিসের, ‘অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার অনুভূতিটা অসাধারণ। আমি এই স্বপ্ন থেকে জাগতে চাই না।’

রিও অলিম্পিকে আনিস অংশ নিয়েছেন ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্টে। সুইমিংপুলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন দর্শক। বাছাইপর্বের বাধা অবশ্য পার করতে পারেননি তিনি। ৫৪.২৫ সেকেন্ডে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করে হয়েছিলেন ৫৬তম। ১০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টেও অংশ নেবেন আনিস।

ইয়েচ পুর বিয়েল (অ্যাথলেটিকস)

নিজ দেশ দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইয়েচ পুর বিয়েল। সেখানেই তিনি আছেন ১০ বছর ধরে। মাত্র এক বছর আগে প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ে অংশ নেওয়া শুরু করেছিলেন বিয়েল। অনুশীলনের জন্য কোনোরকম সহায়ক পরিবেশ না পেলেও হাল ছেড়ে দেননি। আর শেষ পর্যন্ত জায়গা করে নিয়েছেন অলিম্পিকেও।
আজ শুক্রবার বিয়েল অংশ নেবেন ছেলেদের ৮০০ মিটার দৌড়ের ইভেন্টে। সেখানে কোনো সাফল্য না পেলেও কোনো আক্ষেপ থাকবে না তাঁর। তিনি শুধু দেখাতে চান যে শরণার্থীরাও কিছু একটা করতে পারে, ‘আমি কোনো সোনা বা রুপা না পেলেও কিছু যায়-আসে না। আমি শুধু বিশ্ববাসীকে দেখাব যে, শরণার্থী হিসেবেও আপনি কিছু একটা করতে পারেন।’

জেমস চিয়েনজিক (অ্যাথলেটিকস)

বিয়েলের মতো জেমস চিয়েনজিকও এসেছেন দক্ষিণ সুদান থেকে। নিজ দেশে থাকলে এত দিন জেমসের হাতেও হয়তো উঠে যেত প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র। সেই পরিণতি এড়ানোর জন্যই কেনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। শরণার্থী শিবিরে থেকেই ভর্তি হয়েছিলেন কেনিয়ার এক স্কুলে। সেখানেই অংশ নিতেন বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতায়। অধিকাংশ সময়েই তিনি দৌড়েছেন ভুল মাপের জুতা পায়ে দিয়ে। এ জন্য বেশ কয়েকবার পড়েছেন ইনজুরির কবলে। তবে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি জেমসের অলিম্পিক স্বপ্নের সামনে।

আগামী রোববার ৪০০ মিটার দৌড়ের ইভেন্টে অংশ নেবেন জেমস। সেখানে ভালো করা আর অন্য অনেককে সাহায্য করাই এখন জেমসের স্বপ্ন, ‘অলিম্পিকে আমি ভালো নৈপুণ্য দেখাতে চাই। অন্য অনেককে সাহায্য করতে চাই। কারণ, আমি নিজেও অনেকের সহায়তা পেয়েছি। আর এখন আমিও কাউকে না কাউকে সাহায্য করতে চাই।’

পাউলো আমোতুন লোকোরো (অ্যাথলেটিক)

দক্ষিণ সুদানে একটি গরুর খামার ছিল পাউলো লোকোরোর। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাধ্য হন কেনিয়াতে আশ্রয় নিতে। সুদান থেকে কেনিয়ায় আসার পথে শুধুই ফলমূল খেয়ে বেঁচে ছিলেন পাউলো। অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত যখন শরণার্থী শিবিরে যখন পৌঁছেছিলেন, তখন তাঁর পায়ে কোনো জুতা ছিল না।

কেনিয়ায় এসেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন লোকোরো। অংশ নেওয়া শুরু করেছিলেন দূরপাল্লার বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতায়। আর এখন তাঁর চোখে স্বর্ণপদক জয়ের স্বপ্ন, ‘আমি বিশ্বরেকর্ড গড়তে চাই। একটা স্বর্ণপদক জিততে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন।’

আগামী মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) লোকোরো অংশ নেবেন ১৫০০ মিটার দৌড় ইভেন্টে।

অ্যাঞ্জেলিনা নাদাই লোহালিথ (অ্যাথলেটিকস)

লোহালিথও এসেছেন দক্ষিণ সুদান থেকে। গৃহযুদ্ধের কারণে মাত্র ছয় বছর বয়সেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আশ্রয় নিয়েছিলেন কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরে। অ্যাথলেট হিসেবে সাফল্য পেলে আবার তিনি ফিরে যেতে চান নিজ দেশে। পরিবারের জন্য বানাতে চান নতুন একটি বাড়ি।

আগামী শনিবার মেয়েদের ১৫০০ মিটার দৌড়ের ইভেন্টে অংশ নেবেন লোহালিথ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শরণার্থীরা তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হবেন, এমনটাই আশা করছেন ২১ বছর বয়সী এই অ্যাথলেট, ‘অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো শরণার্থীরা অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় আমি খুবই খুশি। এটা অন্য শরণার্থীদেরও অনুপ্রাণিত করবে।’

রোসে নাথিখে লোকেনইয়েন (অ্যাথলেটিক)

প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দক্ষিণ সুদান থেকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরে এসেছিলেন লোকেনইয়েন। নিজে যে ভালো দৌড়াতে পারেন, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। শরণার্থী শিবিরে হঠাৎ করেই একদিন অংশ নিয়েছিলেন ১০ কিলোমিটারের একটি দৌড় প্রতিযোগিতায়। সেখানে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার পরই শুরু করেন অনুশীলন। তবে দৌড়ানোর জন্য নিজের কোনো জুতাও ছিল না লোকেনইয়েনের। গত বছর থেকে তিনি শুরু করেছিলেন জুতা পায়ে অনুশীলন।

আগামী বুধবার (১৭ আগস্ট) মেয়েদের ৮০০ মিটার দৌড় ইভেন্টে অংশ নেবেন লোকেনইয়েন। অলিম্পিকে কোনো পদক জয়ের স্বপ্ন অবশ্য দেখছেন না তিনি। পরিবার ও অন্য শরণার্থীদের সাহায্য করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য, ‘বাবা-মা, ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ানোই আমার স্বপ্ন। আমার প্রথম লক্ষ্য। এরপর আমি সাহায্য করতে চাই অন্য শরণার্থীদের।’

ইয়োনাস কিনডে (ম্যারাথন)

নিজ দেশ ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৩ সালে লুক্সেমবার্গে চলে এসেছিলেন ইয়োনাস কিনডে। নিজ দেশে থাকা অবস্থাতেই তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে। লুক্সেমবার্গের নাগরিকত্ব পেলে হয়তো সেই দেশের পতাকাতলেই অলিম্পিকে অংশ নিতে পারতেন কিনডে। ম্যারাথনে তাঁর সেরা টাইমিং দুই ঘণ্টা ১৭ মিনিট।

রিও অলিম্পিকে আগামী ২১ আগস্ট ম্যারাথন ইভেন্টে অংশ নেবেন কিনডে।

ইয়োলান্ডে মাকিবা (জুডো)

কঙ্গোর গৃহযুদ্ধের কারণে খুব ছোটবেলাতেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন মাকিবা। বেড়ে উঠেছেন পরিবার-বিচ্ছিন্ন শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য হঠাৎ করেই ঝুঁকে পড়েছিলেন জুডোর দিকে। আর সেটাই এখন তাঁকে নিয়ে এসেছে অলিম্পিক পর্যন্ত।

তিন বছর আগে শরণার্থী হিসেবে ব্রাজিলের রিওতে চলে এসেছিলেন মাকিবা। আরো ভালোভাবে শুরু করেছিলেন জুডো অনুশীলন। আর শেষ পর্যন্ত শরণার্থী দলের অংশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন অলিম্পিকে। খুব বেশি সাফল্য অবশ্য পাননি। প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিয়েছেন ইসরায়েলের লিনডা বোল্ডারের কাছে হেরে।

ইয়াসরা মারদিনি (সুইমিং)

অলিম্পিক শরণার্থী দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কেড়েছেন সিরিয়ার ইয়াসরা মারদিনি। সিরিয়া থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় প্রায় তিন ঘণ্টা সাঁতার কেটে তিনি প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ২০ জনের। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন জার্মানিতে। সেখান থেকেই জায়গা করে নিয়েছেন অলিম্পিক শরণার্থী দলে।

রিও অলিম্পিকে মারদিনি অংশ নিয়েছিলেন সাঁতারের দুটি ইভেন্টে। ১০০ মিটার বাটারফ্লাই ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে। কোনো ইভেন্টেই পেরোতে পারেননি বাছাইপর্বের বাধা।

পোপোল মিসেঙ্গা (জুডো)

কঙ্গোয় গৃহযুদ্ধের সময় মাত্র ছয় বছর বয়সেই মাকে হারিয়েছিলেন মিসেঙ্গা। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তাঁর ঘরবাড়ি। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে গিয়েছিলেন জঙ্গলে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় শিশুদের এক আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানেই জুড়ো খেলা শুরু করেন মিসেঙ্গা। ২০১৩ সালে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্রাজিলে।

এবারের রিও অলিম্পিকে নিজের প্রথম ম্যাচে ভারতের অবতার সিংকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মিসেঙ্গা। কিন্তু পরের ম্যাচেই তিনি হেরে যান দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াক ডং-হানের কাছে।