বিদায় উসাইন বোল্ট
অলিম্পিকে আর কখনো দেখা যাবে না অদৃশ্য তীর ছোড়ার ভঙ্গি। দেখা যাবে না সবার আগে ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে বুকে আঘাত করতে করতে রণহুংকার। ‘লাইটনিং বোল্ট’ আর ঝলসে উঠবে না ক্রীড়া মহাযজ্ঞে। ভক্তদের মনে আবেগের ঢেউ তুলে অলিম্পিক থেকে বিদায় নিলেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ স্প্রিন্টার উসাইন বোল্ট।
রিওর অলিম্পিক স্টেডিয়ামের দর্শকরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। তারা অলিম্পিকে বোল্টের শেষ কীর্তির জ্বলন্ত সাক্ষী। জ্যামাইকার গতিদানব বেইজিং, লন্ডনের মতো রিও ডি জেনিরোতেও তিনটি শিরোপা জিততে না পারলে বিরাট অঘটন হতো নিঃসন্দেহে। বিশ্বের দ্রুততম মানব তাঁদের হতাশ করেননি।
আগামীকাল ৩০ বছর পূর্ণ করতে যাওয়া বোল্টের জন্মই যেন অ্যাথলেটিক ট্র্যাক রাঙানোর জন্য। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ভীষণ দুরন্ত। ছেলেকে নিয়ে মা জেনিফার বোল্টের স্মৃতিচারণা, ‘মাত্র তিন সপ্তাহ বয়সে সে ছটফট করত বিছানায়। দেখে মনে হতো ওর শরীরে অনেক শক্তি। একদিন আমি তাকে বিছানায় রেখে একটা কাজ করছিলাম। ফিরে এসে দেখি সে বিছানার এক কোনায় চলে এসেছে। আরেকটু হলেই পড়ে যেত। আমার তখন মনে হলো, এটা কেমন ধরনের বাচ্চা?’
সেই ‘অদ্ভূত’ শিশু যে একদিন দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে, তা অবশ্য ভাবতেই পারেননি বোল্টের মা। যদিও ১২ বছর বয়সে বোল্টই ছিলেন স্কুলের দ্রুততম দৌড়বিদ। কিন্তু তার তিন বছর পর বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটারে অংশ নিয়ে ফিরেছিলেন শূন্য হাতে। তখনো কিন্তু অ্যাথলেটিকসকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেননি বোল্ট। প্র্যাকটিসে তাঁর আয়েশি ভঙ্গি আর অহেতুক মজা করার প্রবণতা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতেন কোচ।
বোল্টের জীবনটা পাল্টে দিয়েছিল ২০০২ সালের বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ। স্বদেশ জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনে অনুষ্ঠিত সেই প্রতিযোগিতায় ২০০ মিটারে স্বর্ণ জয় ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর প্রথম সাফল্য। এর পরই আগ্রহ বাড়তে থাকে অ্যাথলেটিকসের প্রতি। শুরুতে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিতেন না। কিন্তু একসময় চলে আসেন অ্যাথলেটিকসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্টে। আর তার পরই ইতিহাস।
উসাইন বোল্টকে নিয়ে দুনিয়াজুড়ে হৈচৈয়ের শুরু বেইজিং অলিম্পিক শুরু হওয়ার মাস দুয়েক আগে। নিউইয়র্কে এক প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বেইজিং অলিম্পিকে আবার এই ইভেন্টে রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে বার্লিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আবারো বোল্টের ‘বজ্রপাত’। জার্মানির রাজধানীতে ৯.৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার শেষ করে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিলেন তিনি। সাত বছর ধরে টিকে থাকা রেকর্ডটা আজো অটুট।
ট্র্যাকে একের পর এক অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়ে যাওয়াই শুধু নয়, দর্শকদের সঙ্গে মজা করার ক্ষেত্রেও বোল্ট অনন্য। তিন বছর আগে মস্কো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াতে হয়েছিল তাঁকে। তখন তিনি অদৃশ্য ছাতা ধরার ভঙ্গি করে হাসির হুল্লোড় তুলে দিয়েছিলেন গ্যালারিতে। দর্শকদের সঙ্গে মজা করা অবশ্য নতুন কিছু নয় তাঁর জন্য। বোল্টের মতে, ‘আজ বা আগামীকাল কী করতে যাচ্ছি, তা দেখতেই তো লোকে আসে। তাদের জন্য এটা এক ধরনের মজা। আর আমি তাদের মজা দেওয়া উপভোগ করি। তাদের আনন্দ দিতে চাই। কারণ তারাই আমার জীবনের শক্তি।’
দর্শকপ্রিয় বোল্টকে আর কখনো অলিম্পিকে দেখা যাবে না। ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য এটা বিশাল দুঃসংবাদ। তবে সব কিছুরই তো শেষ আছে। সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের শেষ অলিম্পিক যে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হলো, সাফল্যমণ্ডিত হলো, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!