অজুহাত দেওয়াতেই কেবল ধারাবাহিক বাংলাদেশ
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নাম হয়েছে দুটি। পিকনিক টিম ও মায়ের দোয়া ক্রিকেট টিম। ধরা যাক, দলবল বেঁধে বন্ধুরা বনভোজনে গেল। সেখানে খেলাধুলা হয়। সেই দলটাতে যে সিরিয়াসনেস থাকে, তাতেও অন্তত মোটামুটি ১১ জনকে দাঁড় করিয়ে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে লড়াই জমাতে পারত।
পরের নামটিতে আসি–মায়ের দোয়া ক্রিকেট টিম। দোয়া আসে মন থেকে। ক্রমাগত অবাধ্য সন্তানকে মুখে অভিশাপ না দিলেও অন্তরে দুঃখবোধ আসে। হাহাকার তৈরি হয়। যা সন্তানের চলন-বলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশি ভক্তদের অব্যক্ত দুঃখবোধ হতে পারে সেই অভিশাপের দীর্ঘশ্বাস। উপরের দুটি উদাহরণই বাংলাদেশ দলকে নিয়ে।
২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর বাংলাদেশকে নিয়ে সবার একটা কথা ছিল, বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব। ক্রিকেটে নবীন এক দেশ হারিয়েছে বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়াকে, চাট্টিখানি কথা নয়। ১৯ বছর পর বাংলাদেশকে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট কিন্তু লাফাচ্ছে না। বরং অধিনায়ক মোনাঙ্ক প্যাটেল জানিয়ে দিলেন, তারা শেষ টি-টোয়েন্টিটাও জিততে চান। পরপর দুই ম্যাচে বাংলাদেশকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাস উঠেছে তুঙ্গে, তবে তারা পা রাখছেন মাটিতে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের বয়স তো কম হয়নি। রজতজয়ন্তী পেরিয়েছে। একটি দেশের সব মানুষ প্রবল প্রতিকূল পরিবেশেও কখন এক হয়? অন্য কোথায় কী হয় তা জানা না থাকলেও বাঙালি মাত্রই জানে, লাল-সবুজের ক্রিকেট ম্যাচ থাকলে থমকে যায় বাকি সব। প্রত্যাশার যে চাপ, ভক্তদের যত চাওয়া-পাওয়া, সেই অনুপাতে বাংলাদেশ কখনোই ভালো ক্রিকেট খেলেনি। তবু, এতটা বাজেও কি প্রত্যাশায় ছিল? ক্রিকেটাররা নিজেরাও প্রত্যাশা করেছেন এতটা বিচ্ছিরি খেলবেন? প্রত্যাশার বাইরে কিছু হলে, আমরা চুপ হয়ে যাই। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এটি। অথচ, বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা সমানে বকেই যাচ্ছেন। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত থেকে সাকিব আল হাসান, দেশে বসে নির্বাচক হান্নান সরকার—বাদ যাননি কেউই। নিজেদের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। এদিকে, ভক্তরা অন্ধের দেশে আয়না বিক্রির মতো তাদের ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে। টানা ব্যর্থতার গল্প বুকে চাপা দিয়েও ক্রিকেটারদের খেলা দেখতে ঠিকই বসে যাচ্ছে টিভির সামনে।
বাঙালিকে নিয়ে বাঙালির প্রচলিত কথা, বাঙালির হাত তিনটি। ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত। অজুহাতের প্রয়োগ আমাদের ক্রিকেট দল যতবার, যতভাবে করেছে, তার সিকিভাগ চেষ্টা যদি মাঠের ক্রিকেটে করত তাহলে দুর্দশা হতো না। ক্রিকেটারদেরই বা কী দোষ! তারা ভেবে নিয়েছে, সবকিছু টেকেন ফর গ্র্যান্টেড। ভালো তো করে কালেভদ্রে, সেই কয়েক ম্যাচের রেশ রেখে ছাপোষা ভক্তরা সব ভুলে যায়। সাত খুন মাফ করে দেয়।
নাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ হারার পর শান্ত কেন বলবেন, জিম্বাবুয়ে সিরিজে ভালো প্রস্তুতি না থাকার প্রভাব পড়েছে? স্কোরলাইন বলছে, ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। আচ্ছা, প্রথম ম্যাচ বাদ। দ্বিতীয় ম্যাচে হেরে ভূত হওয়ার পর শান্তর অস্ত্র এবার আত্মবিশ্বাস। সাকিবের বুলি, অনুশীলন ঠিকঠাক হয়নি। ম্যাচের দিন দুপুরে দেশে থাকা নির্বাচক হান্নান সরকার আবার বলেছিলেন, ‘শান্ত-লিটন-সৌম্যদের রান না পাওয়ায় লজ্জার কিছু নেই। এমন হতেই পারে, এটাই বাস্তবতা। তাদের প্রমাণ করারও কিছু নেই, দে আর অলরেডি প্রুভেন।’
আমাদের খেলোয়াড়রা ঠিক কোন জায়গায় নিজেদের প্রমাণ করেছেন? মাঠের ক্রিকেটে তো নয়ই। তাহলে? সম্ভবত টানা হারের পরও নির্লজ্জ থাকার ধারাবাহিকতায়। অজুহাত সাজিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়ার দিক থেকে। না কি, নিজেদের উন্নতির কথাই কেবল বলে যাওয়াতে। কে জানে! আধুনিক মনোসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৮৯৫ সালে একটি বই লেখেন ‘স্টাডিজ ইন হিস্ট্রিয়া’ নামে। তিনি সেখানে দাবি করেন, মানুষের শারীরিক উপসর্গগুলো আদতে মনের গভীরে লালিত সাংঘর্ষিক অভিজ্ঞতার অবয়ব। মন হলো পানিতে ভাসমান একটি বরফখণ্ডের মতো। বরফের প্রায় ৯০ ভাগ থাকে পানির নিচে। বিশাল এই অংশটিকে তিনি আখ্যায়িত করেন অবচেতন মন হিসেবে। পানির ওপর থাকা বরফের বাকি ১০ শতাংশ সচেতন মন। আমাদের মানসিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদিত হয় অবচেতন স্তরে।
বাংলাদেশ দলের তারকাদের মধ্যে বিশ্বজয়ের তাড়না নেই। দিগ্বিজয়ী হওয়ার আকাঙ্খা নেই। নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করার আগ্রহ নেই। অবচেতন মনে যখন এত এত নেই-এর বাস, সচেতন মন তখন পথ হারাবেই। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাঁচ উইকেট এবং ছয় রানে হারা ম্যাচ দুটিকে সাধারণ হার হিসেবে নেওয়া যায় না। এর আগে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ হেরেছিল জিম্বাবুয়ের কাছে। জিম্বাবুয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেই, যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সহযোগি সদস্য। নানা দেশের ক্রিকেটার মিলিয়ে দল গঠন করেছে যারা, তাদের কাছেই শান্তরা ছন্নছাড়া।
এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে ১৬৮ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে হেরেছে ১০০টি। তালিকায় দ্বিতীয় নামটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ১৯৩ ম্যাচ খেলে তারা হেরেছে ৯৯টি। এরপর ১৮৯ টি টি-টোয়েন্টি খেলা শ্রীলঙ্কার হার সংখ্যা ৯৮টি। আর ১৪৫ টি ম্যাচ খেলা জিম্বাবুয়ের হারের সংখ্যা ৯৫টি। ২১৬টি টি-টোয়েন্টি খেলে নিউজিল্যান্ড হেরেছে ৯০টিতে। যেখানে মাত্র ২৬টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির অভিজ্ঞতা থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বাংলাদেশ অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে।
সামনে বিশ্বকাপ। প্রস্তুতি নিতে আগেভাগেই মার্কিন মুলুকে পা রাখে বাংলাদেশ। উদ্দেশ্য, দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে না হওয়া প্রস্তুতির ঘাটতি মেটানো। কিন্তু হায়, পাশার দান উল্টে গেল। মাঠের প্রস্তুতির চেয়ে এখন মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি বেশি প্রয়োজন। নইলে, কদিন পর বাঘের মতো বাংলার ক্রিকেটকেও না সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে!