দুই ইতিহাসের সঙ্গী হওয়া অন্যরকম অনুভূতি : শরিফুল
রাওয়ালপিন্ডিতে ইতিহাস গড়ার দুদিন পার হয়ে গেছে। তবে, জয়ের ঘোর এখনও কাটেনি। গেল রাতে ঢাকায় পা রাখা শরিফুল ইসলামের মুচকি হাসিতে ফুটে উঠল সেই প্রতিচ্ছবি। রাওয়ালপিন্ডিতে ইতিহাস গড়ার নায়কদের বিমানবন্দরে ফুল আর মিষ্টিমুখ করিয়ে বরণ করে নিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে কর্তারা। ঢাকায় পা রেখে বেশ হইহুল্লোড় করে নিজ ঘরে ফিরেছেন ক্রিকেটাররা।
বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলামের অবশ্য এমন অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছিল। ২০২০ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ মুখ তিনি। সেবার যুব দলের হয়ে জিতেছেন প্রথম বিশ্বকাপ। এবার জাতীয় দলের হয়ে সাদা পোশাকে প্রথমবার জিতলেন পাকিস্তান সিরিজ। দুই ইতিহাসের অংশ হওয়া শরিফুলকে তাই দোলা দিচ্ছিল ভিন্নরকম অনুভূতি। দেশে ফিরে এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই অনুভূতি প্রকাশ করলেন শরিফুল। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন বাঁহাতি এই পেসার।
ঐতিহাসিক একটি সিরিজ জিতে ফিরলেন কেমন লাগছে?
শরিফুল : আলহামদুলিল্লাহ। একবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিলাম তখন এমন একটা দারুণ অনুভূতি হয়েছিল। এবারও তেমনই ফিল হয়েছে। টেস্ট সিরিজ জিতে যখন দেশে এলাম তখন বিমানবন্দরে অন্যরকম লেগেছে। অনেকটা রাজসিক ব্যাপার। দুইটার ব্যবধান থাকলেও দুটিই প্রথম। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় যেমন দারুণ অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি প্রথমবার পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ও অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দুটোই দেশের জন্য প্রথম এবং দুটোর অংশ হতে পেরে সত্যিই নিজের কাছে ভালো লাগছে। এটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
বিদেশ সফরে বাংলাদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেক, বিশেষ করে সাদা পোশাকে। সেই দিক দিয়ে এবার পুরোপুরি সফল। সবমিলিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
শরিফুল : যখন আমরা লাহোরে গিয়েছিলাম তখন সেখানে অনেক গরম ছিল। সেই কদিন সবাই মিলে অনুশীলন করায় আমরা ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছি। এই জিনিসটা হওয়াতে আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। যার কারণে রাওয়ালপিন্ডিতে আমরা ভালো ফল পেয়েছি। আমার মনে হয়, অনুশীলনের উইকেটটাও ভালো ছিল। যার কারণে, ব্যাটার ও বোলাররা ভালোভাবে প্রস্তুত হবার পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়েছে। এই দিক দিয়ে আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, যে কোনো ট্যুরের আগে আমরা যদি কিছুদিন আগে গিয়ে কন্ডিশনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাই, তাহলে আমাদের জন্য ভালো ফল হবে।
পাকিস্তানের উইকেট নিয়ে স্বাগতিকদের অনেক অভিযোগ। আপনারা কতটা সুযোগ নিতে পেরেছেন?
শরিফুল : ওদের পিচটা ছিল ব্যাটিংবান্ধব। বোলারদের সুযোগ কমই ছিল। যা করতে হতো সেটা বোলারদের ভ্যারিয়শনের মাধ্যমে। বোলারদের লাইন-লেন্থ মেনে খুব সতর্ক হয়ে বল করতে হয়। একটু বাজে বল হলেই রান হয়ে যায়। উইকেটটা খুব ফ্ল্যাট ছিল। আর বাংলাদেশের উইকেটে স্পিনাররা বেশি সুবিধা পায় সেখান দিক দিয়ে বলব, পাকিস্তানের পিচে ব্যাটাররা, স্পিনাররা ও পেসাররা আমাদের সবাই ভালো করতে পেরেছে।
সেদিন সাকিব-মুশফিক যখন ব্যাটিং করছিলেন শেষ দিকে আপনাদের মধ্যে ডাগআউটে কী কথা হচ্ছিল?
শরিফুল : সবাই আমরা তখনও নরমাল ছিলাম। তবে নিজেদের মধ্যে বলতেছিলাম যে, যখন খেলাটা শেষ হবে তখন এটা আমাদের জন্য বিশেষ কিছু হবে। আমরা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানের বিপক্ষে দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ জেতা, সেটাও প্রথমবার। এসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। তবে সবার মধ্যেই একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। এটা ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি জেতা যায়। যে কোনো দিনের খেলায় জেতা যায়। যে কোনো বড় টিমকেই যে কোনো দল সুযোগ নিয়ে হারিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দুইটা টেস্টের নয়টা দিন ডোমিনেট করে জেতা মুখের কথা নয়। আমরা নিজেদের মধ্যে বলছিলাম, আমরা পরিশ্রম করেছি সেই ফল পেয়েছি। এসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল।
দ্বিতীয় টেস্টের আগে জয়ের আত্মবিশ্বাস ছিল কতটা?
শরিফুল : অবশ্যই আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল। আমরা সবাই জয়ের জন্যই মাঠে নামব, এই মনোভাব ছিল। প্রতিটা ক্রিকেটারই নিজেদের সেরাটা দিতে চেষ্টা করব। এটা ভাবনায় ছিল। ফলাফল যাই হোক, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব এই ভাবনা ছিল। আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরা জিতব।
জয়ের পর অনেক ছবি দেখেছি আমরা। সেদিন ড্রেসিংরুমের উদযাপনের গল্প শুনতে চাই?
শরিফুল : আমরা সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করছিলাম। চিল্লাচিল্লি-হইহুল্লোড় করছিলাম। সবাই যে যার মতো ফটোসেশন করেছি। হয়না বড় কোনো ট্রফি জিতলে সবাই অনেক উল্লাস করে তেমন আরকি। অনেক উপভোগ করেছি সবাই মিলে।
দ্বিতীয় টেস্টের শেষ ইনিংসে পেসাররা সব উইকেট নিয়েছে তখন নিজে বোলিং করতে না পারার আক্ষেপ কাজ করছিল কিনা?
শরিফুল : আমার কাছে আফসোস লাগেনি। কারণ পেসার বা স্পিনাররা যারাই উইকেট নিক আমার ভালো লাগে। কারণ দিন শেষে সেটা দেশের জন্য হচ্ছে। দলের জন্য হচ্ছে এটাই স্বস্তিজনক।
দেশের বাইরে পেসারদের দাপট নিজেকে স্বস্তি দিচ্ছে কি?
শরিফুল : একটা সময় দেখতাম যে, আমাদের টেস্টে দুইজন নিয়ে খেলতে হতো। কিন্তু এখন এমন হেলদি প্রতিযোগিতা হয়েছে যে, কাকে রেখে কাকে খেলাবে সেই মধুর সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ পেস বিভাগের অনেক উন্নতি হয়েছে এটা খুবই ভালো দিক।
পেসারদের সেরা সময় চলছে কিনা?
শরিফুল : আলহামদুলিল্লাহ আমরা খুব ভালো সময় পার করছি। পরিসংখ্যান নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না। তবে প্রথম ইনিংসে ওরা ৪৪৮ রান করে ইনিংস ঘোষণা করছিল। সেখানে আমাদের ব্যাটাররা রান টপকে লিডও নিয়েছে। এটা কিন্তু তাদেরও ক্রেডিট দিতে হবে। তাই বলব শুধু পেসাররা না সব বিভাগেই বাংলাদেশ উন্নতি করেছে।
নাহিদ রানার বোলিং কেমন দেখলেন?
শরিফুল : খুবই ভালো ছেলে। নিজেকে নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী। সবাই আমরা ওর সাথে মেশার চেষ্টা করি। ওর সাথে মজা করি। পেস বোলার থেকে শুরু করে সবাই ফ্রি হবার চেষ্টা করি। যাতে সে চাপ অনুভব না করে। তার গতি অমায়িক। সে চাইলেই ভালো জোরে বল করতে হবে। যেটা সবাই পারে না। আমি চাইবো, এই গতিটা যেন নাহিদ ধরে রাখতে পারে। বাংলাদেশ যেন ওর কাছ থেকে অনেক দিন সার্ভিস পায় সেই প্রত্যাশাই থাকবে।
বাংলাদেশের এই অনুপ্রেরণা সামনে কতটা কাজে দেবে?
উত্তর : একটা বড় জয় যে কোনো দলকেই আত্মবিশ্বাস দেয়। উজ্জ্বীবিত করে রাখে। সেক্ষেত্রে আমাদেরও অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। পাকিস্তান সিরিজের অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা ভারতে ভালো কিছু করার অপেক্ষায় থাকব।
সাম্প্রদিক ইস্যুতে সাকিব আল হাসান কঠিন সময় পার করছেন, কাছ থেকে তাকে কেমন দেখেছেন?
শরিফুল : আসলে কিছুটা প্রভাব তো পড়েই। তবে উনি মানসিকভাবে অনেক শক্ত একজন মানুষ। উনি মাঠের ভেতরে ঢুকলে সবকিছু ভুলে যান। আপনারা যারা খেলা দেখেছেন তারা জানেন তার মাঠে কতটা নিবেদন। উনি সবসময় দলে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। দেশের জন্য ফাইট করেন সবসময়।
জয়ের রানটা সাকিবের ব্যাট থেকে যখন তখন কেমন লেগেছে?
শরিফুল : ভালো লাগছিল। ওই সময় মনে হচ্ছিল বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টির শঙ্কাও ছিল। আরেকটা উইকেট গেলে আরেকটু টাইম লেগে যেত জয় আসতে। তাই আমরা সবাই চাইছিলাম মুশফিক ভাই ও সাকিব ভাই ছিলেন। আমরা চেয়েছি যেন তারা দুজন শেষ করে আসতে পারেন। খুবই ভালো লাগছে যে জয়ের রানটা সাকিব ভাইয়ের ব্যাট থেকে আসছে।
সবাই দেশে ফিরে আসার সময় তার সাথে কোনো কথা হয়েছে?
শরিফুল : তেমন কিছু হয়নি। সাকিব ভাই শুধু বলেছেন, ভারত সিরিজে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। এই বলে উনি কাউন্টি খেলতে চলে গেছেন মনে হয়। আমরা দেশে ফিরেছি।
ভক্তদের উদ্দেশে কিছু বলবেন কী?
উত্তর : সবসময় আমাদের সাপোর্ট করবেন। ভালো কিংবা খারাপ সময় পাশে থাকবেন। আমরাও আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব মাঠে আপনাদের ভালোবাসার প্রতিদান দেবার।