ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা, বোনাস— আলো কতদূর?
মোটাদাগে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেটকেই বুঝি আমরা। জনপ্রিয়তায় ক্রিকেটের পরেই ফুটবল। বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। ক্রিকেটে যতটা আলোর রোশনাই, আলাপ ও এর বিস্তার, ফুটবলে তার কিয়দাংশও নেই। ক্রিকেটে দল ভালো খেললে আনন্দে মাতে গোটা দেশ, খারাপ করলে গ্রাস করে হতাশা। সম্প্রতি ক্রিকেট যতটা হতাশ করছে, তারচেয়ে বাড়াচ্ছে বিরক্তি। সেই জায়গা থেকে আলোর দিশা এনে দিল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে ছেলেরা যা করতে পারেনি, মেয়েরা তা করে দেখিয়েছে। সাফে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে এখন সেরাদের সেরা বাংলার মেয়েরা। ক্রিকেটাঙ্গন যখন স্থবির, ফুটবল তখন সরগরম। মেয়েদের এমন ইতিহাস এনে দিয়েছে আনন্দের উপলক্ষ। অক্টোবরে ফোটা প্রথম শিউলি ফুলের সুবাস কিংবা নভেম্বর রেইনের মতো অনুভূতি। হেমন্তের নাতিশীতোষ্ণ বিকেলে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলে যতটা সতেজ হয় প্রাণ, মেয়েদের অর্জন তারচেয়ে ঢের বেশি স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মনে।
দুর্দান্ত এই সাফল্যের পর দেশে ফিরেছে বাঘিনীরা। করা হয় ছাদখোলা বাসে ফের সংবর্ধনার আয়োজন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ভবন পর্যন্ত পুরোটা পথজুড়ে সাবিনা-ঋতুপর্ণা-সানজিদা-সুমাইয়ারা সিক্ত হয়েছেন দর্শকের অকৃত্রিম ভালোবাসায়। পিছিয়ে পড়া নারীদের প্রেরণা দেওয়ার মতো জায়গায় নিজেদের নিয়ে গেছে বাংলাদেশের এই দলটা।
ভালোবাসায় মন ভরে, জীবন তো চলে না। চলতি পথে অর্থের প্রয়োজন। ছাদখোলা বাসের শোভিত ফুল, দর্শকের করতালি, উল্লাসে কিছু সময়ের জন্য হয়তো নারীরা হারিয়েছেন সেই স্বপ্নে, যাতে বিভোর হন প্রতিটি অ্যাথলেট। তবে, ঘোর কেটে যাওয়ার পর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। সেখানে ভীষণ মানবেতর বাংলাদেশ নারী দলের ফুটবলাররা। বেতন বকেয়া, ম্যাচ ফি বাকি, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব— এই দলটার প্রতিবন্ধকতা অনেক। খেলাটাকে ভালোবাসে বলে এতদূর যেতে পেরেছে। কিন্তু, ভালোবাসা নামক জ্বালানিও তো ফুরোয় এক সময়। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে, পেশাদারত্ব ধরে রাখতে, বিশ্ব দুয়ারে অর্জনের ডালি বিস্তৃত করতে চাই সঠিক পরিচর্যা। প্রয়োজন আর্থিক নিশ্চয়তা।
আনন্দের মাঝে তাই নারীদের দুঃখও কম নয়। তাদের খুব বেশি চাওয়া নেই। যতটুকু প্রাপ্য, ততটা দিলেই হবে জ্বালানি, ফের ছুটবে গাড়ি। যে গাড়ি চলে সবুজ ঘাসে দুরন্ত গতিতে। সাফের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখা এই মেয়েদের জন্য এক কোটি টাকা বোনাস ঘোষণা করেছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পুরস্কার দেবে ক্রিকেট বোর্ডও। তাতে, হয়তো সাময়িক সমাধান হবে। বাড়বে প্রেরণা। দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য প্রয়োজন বেতন কাঠামো ঠিক করা, ঘরোয়া ফুটবলের মান উন্নত করা। নারীরা তো এসবই চায়।
বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাংলাদেশ দলকে নিয়ে আসা বাসের চালক যেমন জানালেন, এই সাফল্য তাকেও ভীষণভাবে উৎফুল্ল করেছে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আপনার পরিবারের কোনো মেয়ে যদি আসতে চায় ফুটবলে, দেবেন? তিনি বল ঠেলে দিলেন মেয়ের পায়েই—এটি সম্পূর্ণ তার ইচ্ছা। সমান্তরালে জানালেন, অনিশ্চয়তার কথা। কারণ ওই যে, ঠিকঠাক অর্থ নেই! দর্শকরা ভালোবাসা দিয়েছেন উজাড় করে। তাদের মনেও বেদনার প্রতিচ্ছবি। আমাদের এই দলটাকে যদি ক্রিকেটারদের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, তারা বহুদূর যাবে— প্রতিটি সমর্থকের মুখে একই কথা। এত প্রতিবন্ধতা সামলে যদি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হতে পারে, সাহস পেলে তারা অন্তত এশিয়ায় বাংলার পতাকা ওড়াবে, এই বিশ্বাস সবার মনে।
বাফুফেতে রদবদল হয়েছে কিছুদিন আগে। এসেছেন নতুন সভাপতি। ক্রীড়াঙ্গনের নতুন অভিভাবক আসিফ মাহমুদও বললেন, মেয়েদের ফুটবলের বৈষম্য দূর করতে বাফুফের সঙ্গে আলোচনা চলমান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানালেন, বেতন কাঠামো ঠিক করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। কদিন আগে বাফুফের নবনির্বাচিত সিনিয়র সহ-সভাপতি ইমরুল হাসানও জোর গলায় বলেছেন, অতীত ভুলে সামনে ভালো কিছু আসছে।
প্রত্যেকের কথাই আশা জাগায়। সময়ের ব্যবধানে আশাটুকুই থাকে, বাস্তবে রূপ নেয় না। এবার পরিবর্তিত বাংলাদেশে অন্তত সেটি আলোর মুখ দেখবে বলেই সবার বিশ্বাস। কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। তাই ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা কিংবা বোনাসের চেয়ে জরুরি অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং তার ধারাবাহিকতা রক্ষা। এটি নিশ্চিত করতে পারলে, নারী ফুটবল দল অন্তত আরও গতিশীল যে হবে, তা নিয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই কারও।