আলিবাবার উচ্চপদে বাংলাদেশের মেহেদী রেজা
পড়ালেখায় খুব বেশি মনোযোগ ছিল না। নিয়মিত ব্যাকবেঞ্চার, ফুটবল মাঠেই আগ্রহ বেশি। ফুটবল খেলতেনও ভালো, বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের অনূর্ধ্ব-১৫ টিমে খেলার সুযোগও পেয়েছিলেন, তবে ভাগ্যের বিড়ম্বনায় খেলাধুলা দীর্ঘায়িত হয়নি। আবার শখ হয়েছিল পাইলট হবেন, অথচ পড়েছেন বাণিজ্য বিভাগে। উচ্চতর শিক্ষাও নিয়েছেন সেই ব্যাকগ্রাউন্ডেই। এত কিছুর পর মেহেদী রেজার পরিচয়, বাংলাদেশে প্রযুক্তি পরিসরে দক্ষতম ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম তিনি। বর্তমানে তিনি চীনের বিখ্যাত আলিবাবা গ্রুপে প্রোডাক্ট অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত।
নিজের ক্যারিয়ারের গল্প বলতে গিয়ে মেহেদী রেজা একটি বিষয়ে গুরুত্ব দিলেন। প্রযুক্তি বিষয়ে কাজ তিনি স্রেফ পেশার খাতিরে করেন না। এটা তাঁর প্যাশন, ‘আমি পড়ালেখা করেছি বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করে দেশে ফিরেছি ২০০২ সালে। আমি মা-বাবার একমাত্র ছেলে, তাঁদের ইচ্ছা ছিল আমি দেশে থেকে এখানেই যেন কিছু করি। ক্যারিয়ার শুরু করি প্রশিকার মাধ্যমে। সেটা ২০০৩ সালের কথা। ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে ওয়েবসাইটের ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ফ্ল্যাশ টু-ডি অ্যানিমেশনের কাজ করতাম। আমার এই বিষয়গুলোয় একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়ালেখা ছিল না, শখের বশে নিজে নিজে কিছু পড়েছি আর কিছু কাজ শিখেছি। ওখানে কাজ করতে গিয়েই এইচটিএমএল, সিএসএস, পিএইচপির কাজ শিখে ফেলি। প্রশিকায় পাঁচ বছর কাজ করেছি।’
২০০৮ সালে জাপানে একটি চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ নিয়ে পাড়ি জমান মেহেদী। সেখানে ‘এপ্রিওরি’ (apriori.co.jp) নামে একটি জাপানি ওয়েবসাইটের জন্য কাজ করেন তিন মাস। এ কাজের অংশ হিসেবে তিনি ওয়েবসাইটটি জাপানি ইউনিকোড ভার্সনে ডেভেলপ করেন এবং সাইটের দেখভাল করেন। এর পর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ‘ভনএয়ার’ (Vonair.inc)-এ ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করেন। সেখানকার কাজ নিয়ে বললেন, ‘আমি ওখানে সফটওয়্যার ইউআই ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন এবং অ্যানিমেশনের কাজ করতাম।’
ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে সবারই কোনো না কোনো একটি বড় সুযোগ আসে, যার সদ্ব্যবহার আগাগোড়াই বদলে দিতে পারে জীবনকে। আর এই সুযোগের জন্য তাঁকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ‘২০০৯ সালে আমি দারুণ একটি সুযোগ পেয়ে যাই। গ্লোবালি সেরা একটি ডিজিটাল এজেন্সিতে কাজ করার সুযোগ মেলে আমার, এর নাম হলো উন্ডেরমান। আমি সেখানে ইন্টারঅ্যাকটিভ ম্যানেজার হিসেবে কাজ পাই, আমার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশে উন্ডেরমানের কাজে নেতৃত্ব দেওয়া। এ সময়ে আমি নোকিয়ার ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সব কাজ এবং ডিজিটাল প্রোডাকশনের কাজে মূল সহায়তা দিতাম। এ ছাড়া নোকিয়ার সিআরএম চ্যানেলের দেখাশোনা করেছি। এর পাশাপাশি ডিজিটাল মিডিয়া বিষয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুরে গিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রেনিং নিয়েছি। উন্ডেরমানের হয়ে আমি চার বছর কাজ করেছি।’
২০১৩ সালে ইমপ্রেস গ্রুপের সঙ্গে ‘আইডিজিটাল’ নামে একটি ডিজিটাল এজেন্সির গোড়াপত্তন করেন। এখানে তিনি একই সঙ্গে হেড অব ডিজিটাল এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি কিছু স্থানীয় এবং কিছু বৈশ্বিক ক্লায়েন্টের সঙ্গে বছরখানেকের মধ্যেই সম্পর্ক স্থাপন করেন। এর মধ্যে হুন্দাই, নোকিয়া, পারটেক্স ও রানার ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ সালে কাজ শুরু করেন ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে। সেখানে বছরখানেক দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সুযোগ মেলে আলিবাবা গ্রুপের সঙ্গে কাজের।
চীনের আলিবাবা গ্রুপ ই-কমার্স জগতে একটি বড় নাম। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই অনলাইন মার্কেটপ্লেসটির সদর দপ্তর চীনের হ্যাংজুতে। মেহেদী রেজা এখানে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন প্রোডাক্ট অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে, মূলত বাংলাদেশের জন্য। তাঁর কাজের আওতায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে পাকিস্তান। মূলত ইউসি ব্রাউজার নিয়েই তাঁর কাজ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবহারকারীদের কাছে ইউসি ব্রাউজারকে পছন্দনীয় করে তোলা এবং তাঁরা যেন খুব সহজে এটি উপভোগ করতে পারেন। আমরা এই ব্রাউজারটিকে যথেষ্ট ইউজার ফ্রেন্ডলি করে তুলতে চাই এবং সর্বনিম্ন ডাটাপ্যাক খরচ করে ব্যবহারকারীরা যেন একে ব্যবহার করতে পারেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই।’
বাংলাদেশের ডিজিটাল মার্কেটিং পরিসরকে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখেন মেহেদী রেজা। এই পরিসরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে তিনি মানেন কনটেন্টকে। তবে উপযুক্ত ফলাফলের জন্য গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্টকে আরো বিস্তৃত এবং কার্যকর করে তোলা দরকার বলে মনে করেন তিনি। কনটেন্টের ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন ভিডিওকে। তাঁর মতে, এই পরিসরে ভিডিও কনটেন্টই হতে যাচ্ছে আগামী দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বিষয়।
নিজেকে ডিজিটাল মাধ্যমের ফলপ্রত্যাশী এবং আগ্রহী একজন এক্সপার্ট হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন মেহেদী রেজা। প্রযুক্তির বিষয়ে কেবল পেশাগত নিরিখেই নয়, প্রতিনিয়ত আগ্রহের দিক থেকেও সব সময় তৎপর তিনি। পেশা এবং প্যাশনের প্রেরণায় নিজের কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিসরকে আরো বিস্তৃত ও প্রশস্ত করে তুলতে চান তিনি।