নামেই বুড়া, রূপে জোয়ান ঝর্ণা
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য। আরও বেশি সৌন্দর্য, পাহাড়ের পেটে ঝরা ঝর্ণায়। যা চোখ ধাঁধানো, মন জুড়ানো। এ পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো পাঁচ দিন। হেঁটেছি বান্দরবানের থানচি থেকে রুমা উপজেলার দুর্গম সব পাহাড়ে। দেখেছি, ছয়টি ঝর্ণার মায়াবী রূপ। পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করা পাহাড়িদের জীবনাচরণ দেখেছি, শুনেছি তাদের টিকে থাকার গল্প।
তবে পাহাড়ি এ পথ অনেক কঠিন। যদিও তারচেয়ে বেশি নান্দনিক। জীবনের ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর সময়গুলো নিয়ে এ লেখা। আজ থাকছে যার পঞ্চম পর্ব। চলুন, পাহাড় অভিযানের তৃতীয় দিন রোববারের দুপুর থেকে হেঁটে আসি।
তারতের বাংলা অর্থ বুড়ি, আর তারপির অর্থ বুড়া। সাইতার অর্থ ঝর্ণা। বুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি বুড়ার পথে। বারবার শুনছি, সামনে ভয়ংকর পথ। আমরাও প্রস্তুত। পাহাড়ে ওঠা শুরু করেছি। বৃষ্টি থামল মাত্র। পাহাড় চূড়ান্ত পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে।
গাইড জানিয়ে দিলেন, খুব সতর্কতা অবলম্বন করে হাঁটতে হবে। পা পিছলে গেলেই নিচে পড়তে হবে। আর নিচে পড়লেই মরতে হবে। রুবেল আর প্রিন্স ভাই বলছিলেন, এ পথে অনেক হাঁটতে হবে। তারপি যাওয়ার ভিন্ন একটি পথ আছে, যে পথে একেবারেই কম সময় লাগে বলে শুনেছি।
তবে গাইডের দাবি; যে পাহাড় টপকে আমাদের যেতে হবে, সে পথে দড়ি ধরে ছাড়া হাঁটা যাবে না। ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়। এদিক-ওদিক হলেই জীবনের বারোটা বেজে যাবে। অন্যদিকে আমাদের কাছে দড়িও নেই। ফলে এ চিন্তা বাদ রেখে আমরা হেঁটে চলেছি বাঁশ বাগানের মধ্যে দিয়ে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এত খাড়া পাহাড়ে বাঁশঝাড় কীভাবে সম্ভব; সেটাই ভাবছিলাম।
কিন্তু, এবার ভিন্ন বিপদের শুরু। বাঁশে বাঁশে লেগে থাকা জোঁক এবার আরো বেশি জ্বালানো শুরু করেছে। ঘাড়ে-পিঠে-মাথায় আর হাত-পায়ে তো আছেই, রক্ত খেকো জোঁক ভীষণ উৎপাত শুরু করেছে। কিন্তু, কিছু করার নেই আমাদের। ফলে, জোঁকের ভাবনা ছেড়ে আমরা হেঁটে চলেছি। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। ঘাম ঝরছে, পানি খাচ্ছি। হঠাৎ, বাঁশের শিকড়ে লেগে পা কেটে গেল। দেখছিলাম, আজ ঘাম কিংবা রক্ত ঝরার কমতি নেই!
হাঁটতে হাঁটতে সামনে দেখি, ধসে পড়া পাহাড়ের গর্ত। ওপরে উঠতে হবে এ পথ ধরেই। গাইড একটি বাঁশ কেটে দিলেন সেখানে। আমরা বাঁশ আর গাছের শিকড় ধরে ধরে পার হচ্ছি ধসে পড়া সে পথ। ভয় করছে ভয়ংকর কোনো বিপদের। গলায় ঝুলানো মুঠোফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম। এখন আর ছবি তুলতে কিংবা ভিডিও করতে সাহস পাচ্ছি না।
কাদা লেগে ট্রেকিং স্যান্ডেল ভারি হয়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পা পিছলে একবার পড়ে গেলাম, বাঁশ ধরলাম। বাঁশও উপড়ে গেল! পরে অন্য একটি গাছ ধরে রক্ষা পেলাম কোনোরকমে। এভাবেই পথ পাড়ি দিচ্ছি সবাই। উঁচু থেকে নিচে নামতে নামতে হঠাৎ একটি ঝিরির দেখা। এত বেশি ক্লান্ত লাগছিল যে, ঝিরিতে আসন গেড়ে বসে পড়লাম। ঝিরি থেকে পানিও খেলাম। মনে হলো, কিঞ্চিত শান্তি লাগল।
এবার হাঁটা শুরু করেছি ঝিরি পথ ধরে। কিছুদূর গিয়ে দেখা মিলল তারপি ঝর্ণার। ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকলাম। ঝর্ণার যৌবন দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কেন এ ঝর্ণার নাম তারপি বা বুড়া হলো? দেখতে যৌবনে টইটম্বুর, জোয়ান এক ঝর্ণা! অনেক ওপর থেকে ঝর্ণার পানি ঝরছে নিচে। যা চোখ ধাঁধানো।
অনেক উঁচু থেকে ঝর্ণা ঝরার কারণে পানির গতি বেড়ে নিচে এসে আছড়ে পড়ছে শাঁ শাঁ শব্দে। আছড়ে পড়ার কারণে পানি উঁচুতে লাফিয়ে উঠছে। সে পানিতে শরীর ভিজছে। নরম অনুভুতি খেলা করছে শরীর জুড়ে। আরাম লাগছে। উপভোগ করছি। মনোমুগ্ধকর। মনে হচ্ছে, ভীষণ ক্লান্ত শরীর হঠাৎ তরতাজা হয়ে উঠেছে। এসব ভাবছি আর তৃপ্ত হচ্ছি।
এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঠিক ঝর্ণার সামনে গিয়ে বসলাম। ধোঁয়া উড়াচ্ছি আর উপভোগ্য করে তুলছি সেখানকার চমৎকার পরিবেশ। মনে হচ্ছে, ঝর্ণার ঠিক সামনেই বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ, ভীষণ কষ্টের ফলে একটু আগেই মনে হচ্ছিল; ঝর্ণা না দেখেই ফিরে যাই! তখন শরীর আর চলছিল না।
কিন্তু, ফিরে যাওয়ার জন্য তো আসিনি। বেঁচে থাকতে নির্ধারিত গন্তব্য শেষ না করা পর্যন্ত ফিরে যাব না, এ মনোভাব অভিযান শুরু থেকে। পাহাড়ে এসে একটি ব্যাপার খুব মনে ধরেছে। ভীষণ ক্লান্ত শরীর মুগ্ধ মননে হঠাৎ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে! ভীষণ পুলকিত হয়ে ওঠে চারপাশ। এ সৌন্দর্য বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন।
এখন আমরা একে অপরের ছবি তুলে দিচ্ছি, ভিডিও করছি। সব ক্লান্তি যেন শেষ! ঝর্ণার নিচে যেতে চাইলাম, এমন সময় গাইড সিগারেট টানতে চাইলেন। সিগারেট টানতে টানতে তিনি বললেন, ‘ওই দেখেন, ঝর্ণার ঠিক নিচে একটি সাপ!’ একবার চোখে পড়ল। পরে আর খুঁজে পাইনি। গাইড বললেন, ‘নিচে যাওয়ার দরকার নেই। এসব বিষধর সাপ। বিপদ হতে পারে।’ তবু নিচে যেতে চাইলাম। কিন্তু, গাইড আর নিচে নামতে দিলেন না।
এভাবে ঝর্ণার সামনেই আরও বেশ কিছু সময় কাটালাম। কিন্তু, অতৃপ্তি থেকে গেল। বারবার মনে হচ্ছে, এ ঝর্ণায় আবার আসতে হবে এবং নিচে অগজর থাকলেও নামতে হবে! এ আক্ষেপ নিয়ে বিদায় জানালাম যৌবনে টইটম্বুর এক বুড়াকে।
একটু আগে ঠিক যে পথ ধরে এ ঝর্ণায় এসেছি, সে পথ দিয়েই এখন ফিরতে হবে। বাঁশ বাগানের কথা ভেবে শরীর আঁতকে উঠল। এ পর্যন্ত যতগুলো পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়েছি, এ পথ সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে। পুনরায় বাঁশ বাগানের মধ্যে দিয়ে খাড়া পাহাড়ে ওঠা শুরু করেছি। একই পথ, একই পাহাড়।
পাহাড়ে উঠতে উঠতে রুবেল ভাইয়ের গলায় ঝোলানো মুঠোফোনটি কোথায় যেন পড়ে গেছে। পরে খুঁজতে গিয়ে যদিও পাওয়া যায় ফোনটি। কিন্তু, ফেরার পথে রুবেল ভাইয়ের পায়ের আঙুল কেটে যায় পাথরের আঘাতে। ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখি, জোঁক রক্ত খাচ্ছে। না পেরে গেঞ্জি খুলে ফেললাম। দেখি, গেঞ্জিতেও জোঁক। সারা শরীরের কোথাও যেন জোঁকে ধরতে আর বাদ নেই!
এভাবে আমরা আবারও পূর্বের ঝিরি পথে এসে হাজির। শরীর এতটাই ক্লান্ত হয়ে উঠেছে, ঝিরির হাটু পানিতেও ডুব দিতে দ্বিধাবোধ করলাম না। গোসল সেরে স্বস্তি লাগছে মনে হলো। এভাবে আমরা যে পথ দিয়ে এখানে এসেছি, সে পথ দিয়েই ফিরছি। সবুজ রঙের সেই সাপ দেখার স্থানে যখন পৌঁছেছি, তখন আবার ভয় করতে শুরু করে। যদিও মনে মনে ভাবছিলাম, সাপটি হয়তো ভদ্র! নতুবা ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারত।
যে পথ দিয়ে যাচ্ছি, এ পথ দিয়ে সন্ধ্যায় আবার ফিরতে হবে। এ ভাবনায় সবাই মিলে আমাদের মূল গাইডকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলছিলাম। কারণ, গাইড আমাদের থিংদুলতে পাড়ায় পুনরায় যেতে না বললে বাড়তি কষ্ট করা লাগত না। থিংদুলতে পাড়া থেকে আমরা থাইক্ষ্যং পাড়াতে যাব। ওই পাড়াতে যেতে হলে পুনরায় এ পথেই আসতে হবে। ফলে, গাইড চাইলে আমাদের জিনিসপত্র এ পথে কাছাকাছি এনে রাখতে পারতেন। তাতে আমাদের কষ্ট কম হতো। এখান থেকে সোজা থাইক্ষ্যং পাড়াতে চলে যেতে পারতাম।
এভাবে আমরা পাহাড়ি পথ মাড়াতে মাড়াতে থিংদুলতে পাড়াতে যখন পৌঁছাই, তখন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। একটুও বিশ্রাম নিতে দিলেন না গাইড। বললেন, থাইক্ষ্যং পাড়ায় যেতে যেতে রাত হবে। অনেক রাত হয়ে গেলে জীব-জন্তু ঝামেলা করতে পারে। ফলে, এখনি বের হতে হবে। কিন্তু, তখন শরীর আর একদমই চলছে না। একদিকে জোঁকের কামড়ে অতিষ্ট, অন্যদিকে পা ফুলে গেছে। শাকিলের পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হচ্ছে, লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
গাইডের ধারণা ছিল, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হলে আমরা থিংদুলতে পাড়ায় আরও এক রাত থেকে যাব। কিন্তু, গাইডের এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, আমার বুধবার সকালের আগে ঢাকায় ফিরতে হবে। ছুটি শেষে এ দিনই অফিসে হাজির হওয়ার কথা। যাইহোক, গাইড যখন বুঝে গেছেন এখানে আমরা আর থাকব না; তখন তিনি রাগ করলেন। বললেন, ‘চলেন, এখনি বের হব।’ এ পাড়ায় থাকলে গাইড কিছু টাকা বেশি পেতেন। একই সঙ্গে আমাদের তিনবেলার খাবারের জনপ্রতি ১০০ টাকা তো আছেই। এখানে তাঁর একটি বড় লাভের হিসাব আছে।
যাইহোক, কারো শরীরের দিকে না তাকিয়ে তড়িঘড়ি রওনা দিতে বাধ্য হই আমরা। একই পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা রওনা দিই থাইক্ষ্যং পাড়ার উদ্দেশে। চারিদিকে তখন অন্ধকার হয়ে উঠেছে। আমরাও হেঁটে চলেছি। এভাবে দুই-তিনটি উঁচু পাহাড় অতিক্রম করার পর গাইড জানালেন, আমরা প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি। কিন্তু, পথ যেন আর শেষ হয় না। থাইক্ষ্যং পাড়া অনেক উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত। হাঁটতে হাঁটতে পা লেগে যাচ্ছিল, আর কোনোভাবেই শরীর চলছিল না।
রাত তখন আটটা। আমরা এখন থাইক্ষ্যং পাড়ার প্রবেশপথে। গাইড জানালেন, গতকাল শনিবার একবার এখানে সেনাবাহিনীর লোকজন এসে জানিয়ে গেছেন; যাতে কোনো ট্যুরিস্ট পাড়ায় থাকতে না পারে। গাইড বললেন, ‘কোনোদিকে তাকাবেন না। কারো সঙ্গে কথা বলবেন না। সোজা একটি ঘরে গিয়ে উঠবেন। গোসল সেরে বিশ্রাম করবেন। আমি রান্না শুরু করব। খাওয়া শেষে আপনারা ঘুমিয়ে যাবেন। সোমবার সকালেই ‘ডাবল ফলস সাইতার’ দেখতে যেতে হবে।’