ঈদের ছুটিতে
চলুন যাই এশিয়ার পরিচ্ছন্ন গ্রামে, খরচ ১৬০০ টাকা
উত্তরপূর্ব ভারতে ‘সেভেন সিস্টারস স্টেটস’ বলে খ্যাত সাতটি রাজ্যের মধ্যে একটি মেঘালয় রাজ্য। এই রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম মওলিননং। এই উপজাতি অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রামটিই ‘এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম’-এর মর্যাদা পেয়েছে ২০০৩ সালে। ‘ডিসকভার ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন’-এর সদস্যদের বিশেষ পর্যবেক্ষণের পর এই সম্মান পেয়েছিল গ্রামটি।
প্রকৃত অর্থেই নির্মল গ্রাম। নিঃশ্বাসে বিষ ঢোকে না, নেই কোনো কোলাহল , প্রকাশ্যে মানুষ বা জন্তুর বর্জ্য পড়ে থাকে না, মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সরকারি কর্মচারীরা ২৪ ঘণ্টা নজর রাখেন গ্রামটির ওপর। আসছে বন্ধের সময় যে কেউ সহজেই ঘুরে আসতে পারেন সিলেট থেকে কাছের দূরত্ব শিলংয়ের মওলিননং গ্রাম থেকে। আর চাইলে দিনে দিনে ঘুরে আসতে পারবেন তবে আপনাকে যেতে হলে ইন্ডিয়ান ভিসা লাগাতে হবে আর বর্ডার দিতে হবে ডাউকি। আর খরচের কথা ভাবছেন মাত্র এক হাজার ৬০০ টাকা।
যা দেখবেন
একদিকে ধূসর পাহাড়ের শ্রেণির গা থেকে শুরু করে চারদিকে সবুজের সমারোহের মাঝখানটিতে অবস্থিত গ্রামটি। ভারত বাংলাদেশ সীমানার ধার ঘেঁসে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গ্রামটি শিলং থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে। পথেই দেখা পাবেন গোছা গোছা ফুলঝাড়ু পিঠে নিয়ে হেঁটে চলেছেন খাসিয়া রমণীরা ৷ গ্রামের চারদিকে সবুজের সমারোহ। কালচে সবুজ, টিয়া সবুজ,পান্না সবুজ,নানা রকম সবুজ গাছপালায় সাজানো ছবির মতো একটি গ্রাম। রাস্তার মাঝেমধ্যেই রয়েছে ময়লা ফেলবার পাত্র। সবই জৈব পদার্থে তৈরি। কাঠ বা বাঁশের তিনটি খুঁটির ওপর রাখা আছে বাঁশের চাঁচাড়ি থেকে তৈরি তিনকোণা ডাস্টবিন। সেখানেই ফেলে দেয় রাস্তার আবর্জনা। এসব ডাস্টবিন থেকে জৈব আবর্জনাগুলো সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে গ্রামবাসী জৈবসার তৈরি করে ব্যবহার করেন জমিতে। গোলকধাঁধার মতো রাস্তা চলে গেছে নানাদিকে। একটি রাস্তা ধরে চলতে থাকলে দুই পাশেই দেখা যাবে বাড়িঘর। ঢালু রাস্তা ক্রমশ উঁচু হতে হতে ঢুকে গেছে গ্রামের ভিতরে। নানাদিকে রাস্তা গেছে, আর দুই ধারে বাড়িঘর। বাগান আছে প্রতি বাড়িতে। গ্রামের বাড়িঘর বাঁশ ও টিনের তৈরি। চেরা বাঁশের পাটাতনের ঘরের মেঝে, সেও বাসিন্দারা মুছে পরিষ্কার করে রাখেন। প্রতিটি বাড়িতেই আছে বিরাট বিরাট পাথরের চ্যাপ্টা চাঁই। প্রায় প্রতিটি চাঁইতেই আছে তিনটি করে ছোট্ট গর্ত, কোনটিতে আবার দুটো গর্ত। যে গর্তগুলি একটু বড়ো সেগুলোতে জল ধরা আছে। গ্রামের ভিতরের দিকে জমি ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। বিরাট বিরাট পাথরের নানা আকারের চাঁইয়ের সঙ্গে আছে এক বিরাট ‘ব্যালান্সিং রক’। একটি বিরাট পাথরের ওপর আর একটি বিরাট পাথর আশ্চর্যভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে, কোন অজানা কাল থেকে কেউ জানে না। তবে এখন সেটির নিচে ঠিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বর্তমানে এই গ্রামে ৯৫টি পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন মানুষের বাস। মওলিননংয়ে গেলে তার ঠিক পাশের গ্রাম নাহোয়েটের প্রধান আকর্ষণ লিভিং রুট ব্রিজ না দেখে ফেরা মানে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু না৷ একদিকে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে সাথে পাহাড়ি নদীর স্রোতের আওয়াজ কানে ভেসে আসবে । লিভিং রুট ব্রিজে বিশাল আকারের কয়েকটা গাছের শিকড় আর ডালপালা মিলেমিশে এক অদ্ভুত বুনট তৈরি হয়েছে যার নাম জীবন্ত সেতু ৷ সেতুর উপরে-নিচে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় মাপের পাথর৷ চারদিকে সবুজ ঘন জঙ্গল৷ নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি খরস্রোতা থাইলং নদী। প্রসঙ্গত, মেঘালয়ের প্রাচীন খাসি উপজাতির মানুষদের চোখে প্রথম পড়ে ফাইকাস ইলেকটাস নামের এক প্রজাতির রাবার গাছ ৷ খাসি ও জয়ন্তি পাহাড়ের দক্ষিণের বনজঙ্গলে জন্মানো এই গাছের মূল শিকড় মাটির নিচে থাকলেও পরে শিকড়গুলো আড়াআড়িভাবে মাটির উপর বেড়ে ওঠে৷ আর এই শিকড়েই রয়েছে জীবন্ত সেতুর প্রযুক্তির ইতিহাস ৷ এখানকার মানুষেরা সুপারি গাছের কাণ্ড ফাঁপা করে কেটে দেন ৷ তার ভিতর জীবন্ত রাবার গাছের শিকড় ঢোকানো হয়৷ এরপর তারা নিজের ছন্দে বেড়ে চলে৷ শিকড় নদী পেরিয়ে গেলে ফাঁপা সুপারি গাছ কেটে ফেলা হয়৷ রবারের শিকড় সহজেই মাটিতে ঢুকে যায়৷ সেতুর ভিতও শক্ত হয়৷ এমন একখানা প্রাকৃতিক ঝুলন্ত সেতু তৈরি হতে সময় নেয় প্রায় ১৫ বছর৷ দৈর্ঘ্য ৫০ মিটারের বেশিও হয় অনেক সময়৷ একসঙ্গে ৫০-৬০ জন চলতে পারে এই সেতুপথে৷ প্রকৃতি আর স্থানীয় মানুষের কারিকুরিতে জীবন্ত সেতু অন্যতম দর্শনীয় স্থান মওলিননংয়ের ।
জেনে রাখা ভালো
মেঘালয়ে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা খাসিয়া। পরদেশিদের সঙ্গে অবশ্য হিন্দি-ইংরেজি মেশানো এক মিশ্র ভাষায় কথা বলে স্থানীয়রা। তামাবিল সীমান্তে ভ্রমণ কর দেওয়ার মতো ব্যাংক নেই, এ জন্য বেশ খানিকটা দূরে যেতে হতে পারে। তাই ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর পরিশোধ করে যাওয়া ভালো। এ ছাড়া সীমান্ত পার হওয়ার পর মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগও খুব সীমিত। তাই প্রাথমিক ঘোরাফেরার জন্য যত দূর সম্ভব সীমান্ত এলাকায়ই বেশ কিছু ডলার ভাঙিয়ে নিন।
যেভাবে যাবেন –
প্রথমত আপনাকে ইন্ডিয়ার ভিসা করতে হবে রুট দিতে হবে ডাউকি বর্ডার আর আপনি চাইলে একদিনেই গিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন। সময় কম থাকলে সেক্ষেত্রে আপনকে সিলেটে এসে পৌছাতে হবে । ঢাকা থেকে সিলেটে এসি/নন এসি বাসে ভাড়া পড়বে ৩২০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। এর পর সরাসরি সিএনজি অথবা মাইক্রোবাসে করে তামাবিল বর্ডার ভাড়া পড়বে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে সেখান থেকে জিপ অথবা ট্যাক্সিতে করে সোজা মওলিননং যাওয়া যাবে।
ছবি – সুমন্ত গুপ্ত