ঢাকা থেকে হাকালুকি হাওর যাওয়ার উপায়,থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
নদীমাতৃক বাংলাদেশে আসল নৈসর্গ ধারণ করে আছে এর হাওরগুলো। তন্মধ্যে হাকালুকি হাওর ভ্রমণ পর্যটকদের জলজ সৌন্দর্য্যের স্বাদ প্রাণ ভরে আস্বাদন করতে দেয়। মুগ্ধতার প্রধান বৈশিষ্ট্য যখন জল তখন সর্বোচ্চ উপযোগিতা পাওয়ার একমাত্র সময় হচ্ছে বৃষ্টির মৌসুম। হাওরের আয়নায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সাজগোজ দেখার ঝোঁক কোন ভ্রমণপিপাসু হৃদয়ই এড়াতে পারে না। আশেপাশের নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি যেন সেই আয়নার চৌহদ্দিতে সবুজ কারুকাজ হয়ে থাকে। এমনি সুন্দরের আধার হাকালুকি হাওর ভ্রমণের আদ্যোপান্ত নিয়ে আজকের ভ্রমণ বিষয়ক ফিচার।
হাকালুকি হাওরের অবস্থান
বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওর একটি মিঠাপানির জলাভূমি। এই বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি কুশিয়ারা নদীর সাথে উত্তরে সোনাই বরদল নদী, পশ্চিম ও দক্ষিণে ফেঞ্চুগঞ্জ-কুলাউড়া রেলপথ এবং পূর্বে কুলাউড়া-বিয়ানীবাজার সড়ক দ্বারা পরিবেষ্টিত।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভারতের সীমান্তবর্তী এই হাওরটির মোট আয়তন প্রায় ১৮,৪০০ হেক্টর। এর ১৮১.১৫ বর্গকিলোমিটার উপরিভাগের মধ্যে প্রায় ৪০.০১ শতাংশ তথা ৭২.৪৬ বর্গকিলোমিটার পড়েছে বড়লেখা উপজেলায়। এছাড়া এটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা সহ সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত প্রশস্ত। এই বিস্তীর্ণ জলাধার হাকালুকিকে বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর এবং এশিয়ার বৃহত্তর জলাভূমিগুলোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করেছে।
হাকালুকি হাওরের নাম নিয়ে মজার গল্প
বহু বছর আগে ত্রিপুরায় ওমর মানিক্য নামে এক শক্তিশালী রাজা ছিলেন। হ্যাঙ্গর সিং ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের কুকি উপজাতির নেতা। ওমর মানিক্যের প্রতাপের কারণে হ্যাঙ্গর সিং তাকে বেজায় ভয় পেতেন। একবার হাঙ্গর সিং রাজ্যের ক্ষমতা নিয়ে রেষারেষির সময় পালিয়ে যান হাওর এলাকায়। এলাকাটির স্থানীয় ভাষায় হাওর মানে লুকি। তাই লোকেরা এই অঞ্চলটিকে হ্যাঙ্গর লুকি নামে ডাকতে শুরু করে। সময়ের বিবর্তনে এই হ্যাঙ্গর লুকিই পরবর্তীতে হাকালুকিতে পরিবর্তিত হয়।
হাকালুকি হাওরের প্রধান আকর্ষণ
বাংলাদেশ সহ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় হাওরটিকে দেখতে প্রায়ই পর্যটকরা এখানে ভিড় জমান। ১০টি নদী ও ২৪০টি বিলের এই হাকালুকি হাওর ভ্রমণ মানে রীতিমত পানির উপর জীবন যাপন। বাংলাদেশের পাঁচটি উপজেলা নিয়ে এই মিঠা পানির হ্রদ। জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে এখানে এত পানি থাকে যে মনে হয় সমুদ্র। আর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির সময়টা পুরোটাই থাকে পরিযায়ী পাখিদের দখলে। জলাভূমি দিয়ে যত দূর যাওয়া যায় ততদূর দু’চোখ ভরে শুধু অতিথি পাখি দেখার জন্য জনপ্রিয় জায়গা হাকালুকি হাওর। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন জাতের জলপাখি বা জলকুক্কুট প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি।
এ ছাড়াও স্থানীয়দের জীবন এবং বিস্তীর্ণ জলের মাঝে কিছু দূর পর পর ঊঁকি দেয়া দ্বীপগুলো দারুণ রোমাঞ্চ দেয়। এর ওয়াচ টাওয়ারগুলোও এখন দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নৌকা ঘাট থেকে প্রথম ওয়াচটাওয়ারে পৌছতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লেগে যায়। এরপর আরও তিনটি ওয়াচ টাওয়ার আছে, যেগুলো ইঞ্জিন নৌকাতেই যেতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। এছাড়া বড়লেখা শহর থেকে একটু ভেতরে হল্লা এলাকায় এই হাওরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র। এখানেও নৌকা করে ঘোরা ও ওয়াচটাওয়ারের ব্যবস্থা আছে।
ঢাকা থেকে হাকালুকি হাওর যাওয়ার উপায়
মৌলভীবাজার সদর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই হাওরে যেতে হলে ঢাকা থেকে প্রথমে মৌলভীবাজারে যেতে হবে। মৌলভীবাজার থেকে বাসে করে বা সিএনজি অটোরিকশায় হাকালুকি হাওরের নৌকা ঘাটে যাওয়া যায়। বিকল্প উপায় হিসেবে সিলেট রেলস্টেশনের আগে মাইজগাঁও হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে যাওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশাতে করে ঘিলাসরা জিরো পয়েন্ট। এখান থেকেই হাওর ঘোরার জন্য নৌকা ভাড়া করা যায়।
ঢাকার আবদুল্লাপুর, গাবতলী, মহাখালি, ফকিরাপুল, ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি সিলেটের অনেক বাস আছে । এগুলো ৩৫০ থেকে ৯০০ টাকা ভাড়ায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় নামিয়ে দিবে। ট্রেনে কুলাউড়া যেতে হলে ক্লাস ভেদে খরচ পড়বে প্রায় ২৮০ থেকে ৬৩৯ টাকা। সময় বাঁচাতে বিমানে করেও সিলেট যাওয়া যেতে পারে। সিলেট পৌছে সেখান থেকে বাসে করে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া। কুলাউড়া থেকে সরাসরি অটোরিকশায় ঘিলাসরা জিরো পয়েন্টের নৌকা ঘাটের ভাড়া প্রায় ৬০ থেকে ১০০ টাকা।
বড়লেখার পর্যটনকেন্দ্রটি দেখতে হলে কুলাউড়া থেকে বাসে বা সিএনজি অটোরিকশায় করে বড়লেখায় যেতে হবে। অতঃপর সেখান থেকে আবার অটোরিকশা বদলে যেতে হবে শহর থেকে ১১ কিলোমিটার ভেতরে হল্লায়।
মাইজগাঁও হয়ে যেতে হলে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক আগের স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে যেতে হবে। এছাড়া ঢাকা থেকে বাসে করেও ফেঞ্চুগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে আসা যায়।
সিলেটের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে হাকালুকি হাওরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার ক্ষেত্রে সিলেট থেকে মাইজগাঁওতে আসা যেতে পারে। ট্রেনে ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা আর ফেঞ্চুগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত বাস ভাড়া পড়বে ৭০ টাকা। পৌছাতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগতে পারে। সেখান থেকে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়ায় চলে যেতে হবে ঘিলাসরা জিরো পয়েন্ট। এবার দরদাম করে নৌকা ঠিক করার পালা।
ঘাট থেকে প্রায় ১০ থেকে ১৫ জনের জন্য একটি নৌকা ঠিক করে পার হতে হবে কুশিয়ারা নদী। ছোট্ট দল হলে বড় গ্রুপের সাথে অন্তর্ভূক্ত হওয়া যেতে পারে। এক দিনের জন্য নৌকার ভাড়া প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। এই নদীই হাকালুকি হাওরে পৌছে দেয়।
হাকালুকি হাওর ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
যাদের ডে-ট্যুর দেয়ার পরিকল্পনা নেই তাদের রাত্রি যাপনের জন্য হাকালুকি হাওর ভ্রমণ শেষ করে সিলেটে ফিরে আসাই ভালো। কারণ সেখানে রাতে থাকার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। মৌলভীবাজার শহরে বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল আছে। শ্রীমঙ্গল ও নিকটবর্তী উপজেলার আশেপাশে আছে বেশ কয়েকটি ৫ তারকা রিসোর্ট।
অবশ্য জলাভূমির ইজারাদারদের কটেজে থাকার অনুমতি চাওয়া যেতে পারে। আর শীতকাল হলে শুকনো বিস্তীর্ণ ভূমিতে তাঁবু বানিয়ে রাত কাটানো যেতে পারে। এই ক্যাম্পিং অভিজ্ঞতা বাকি জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই শীতকালে হাকালুকি যাওয়ার আগে ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জাম নেয়া হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
আর খাবারের ক্ষেত্রে চাল-মাছ-মুরগী সাথে নিয়ে গিয়ে হাওর এলাকার শ্রমজীবী মানুষকে সামান্য কিছু টাকা দিলে পছন্দ মতো রান্না করে দিবে। তাদের সাথে সুস্বাদু খাবার বা টাটকা মাছের ঝোলের তরকারি নিমেষেই শেয়ার করা যেতে পারে। নৌকায় উঠার আগে কী আনতে হবে সে সম্পর্কে মাঝিদের সাথে কথা বলা যেতে পারে। অতঃপর প্রয়োজন মত বাজার করে নিয়ে নৌকায় উঠা যেতে পারে। কিছু টাকার বিনিময়ে নৌকার মাঝিই সুন্দর করে রান্না করে দিতে পারে। নৌকায় উঠার সময় বিশুদ্ধ পানির সাথে চা, বিস্কুট ও পাউরুটির মত শুকনো খাবার সাথে নিয়ে উঠা উচিত।
শীতকালে ক্যাম্পিং-এর পাশাপাশি বার বি কিউয়েরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্ষা-শীত দুই ঋতুতেই হাকালুকির নানা জাতের তাজা মাছ ভোজনে তৃপ্তি দেবে। ভোজন বিলাসী পর্যটকরা হরহামেশাই হাকালুকির পাড়ে মাছ ভেজে রান্না করে রসনা বিলাসে মেতে উঠেন।
সবশেষ, বর্ষণমুখর দিনে হাকালুকি হাওর ভ্রমণ নিঃসন্দেহে দারুণ একটি অভিজ্ঞতা কিন্তু এ সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষ করে বর্ষার ঠিক পরে বন্যার কারণে এই হাওর অঞ্চল বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাই একদিনের জন্য গেলেও সাথে যথেষ্ট ওষুধপত্র নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া কাদা-পানিতে চলার মত উপযোগী জুতা, পোকা-মাকড় নিরোধক এবং শুকনো খাবার সাথে রাখা উচিত। স্থানীয়দের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে, কেননা কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সবার আগে তারাই সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। দিক-নির্দেশনা থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদের সাহায্য নেওয়ার সময় বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে।