ঈদের ছুটিতে
হাজারিখিল অভয়ারণ্যের নির্জনতায়
পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম। কর্মব্যস্ত জীবনে একটু সুযোগ পেলেই চট্টগ্রাম ছুটে যাই সবুজ প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের আশায়। এবারের চট্টগ্রাম যাত্রা ব্যক্তিগত কাজের সূত্রে হলেও সঙ্গে দুই প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী সুজন ভাই আর নিরুর সময় মিলে যাওয়াতে একটা ডে ট্যুরের প্ল্যান হয়ে গেল।
নির্দিষ্ট দিন সকালেই সবাই মিলিত হলাম মুরাদপুর। আমাদের বেশির ভাগ ট্যুরেই সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা গন্তব্য থাকে না। এবারও হুটহাট আলোচনায় ফটিকছড়ির পথে রওনা হলাম। মূল গন্তব্য হাজারিখিল অভয়ারণ্য। পথিমধ্যে মাইজভান্ডার গেট নেমে দেখা হলো গাউছুল আজম মাইজভান্ডারির দরবার শরিফ। সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজিতে হাজারিখিল অভয়ারণ্যের দিকে ছুটলাম।
মেইন রোড ছেড়ে বায়ের আঁকাবাকা রাস্তা পেরিয়ে আধা ঘণ্টার মতো লাগল পৌঁছাতে। হাজারিখিলের আগে একবার এলেও প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে তখন বুনো পথে ট্রেকিংয়ের আর সুযোগ হয়নি। তবে এই এলাকার স্নিগ্ধতা আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে দ্বিতীয় বার আসার পরিকল্পনায় তাই আর দ্বিধা হয়নি। প্রবেশ পথের গেটে নেমে আগে চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম। গেটে নাম এন্ট্রি করে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
জানা যায় ২০১৪ সালে ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার একর বনাঞ্চলকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয় যা হাজারিখিল অভয়ারণ্য নামে পরিচিত। পর্যটকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত না হলেও এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। ইউএস এইড এবং বনবিভাগের সমন্বয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এখানে ট্রি এক্টিভিটি, ক্যাম্পিং ছাড়াও নানান ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রবেশ পথ পেরিয়ে ঢুকতেই ডানপাশের রাস্তা চলে গেছে ট্রি এক্টিভিটি পয়েন্টের দিকে। ৫ স্টেপের এই চ্যালেঞ্জের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়ে থাকে। আমরা এক্টিভিটির দিকে না গিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বাম পাশের এলাকাজুড়ে সবুজে ঘেরা রাঙ্গাপানি চা বাগানের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে।
চা বাগান পেরিয়ে একটু সামনে যেতেই একটা খাবারের দোকান রয়েছে। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা তারাই করে থাকে৷ যেহেতু ট্রেকিং করে ফিরতে দুপুর হবে তাই আগেই খাবারের অগ্রিম অর্ডার করে দিলাম। অতঃপর জামা কাপড় পালটে ঝিরিপথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এই ট্রেইলে টুরিস্টের আনাগোনা এখনো খুব বেশি না হওয়াতে বেশ পরিচ্ছন্নই মনে হলো। সাত-আট কিলোমিটার দূরত্বের এই ট্রেইলটা কালাপানি ঝরনায় গিয়ে মিলেছে। এই পাহাড়গুলো মিরসরাই –সীতাকুণ্ড রেঞ্জের সঙ্গে মিলেছে বলেই ঐদিকের ট্রেইলের সঙ্গে বেশ মিল আছে।
ঘণ্টাখানেক পরও যখন রাস্তা ফুরাচ্ছিলো না তখন একটু দ্বিধায় পড়লাম ঠিক পথে যাচ্ছি কি না? এতটা লম্বা পথ আশা করিনি। তবু দ্বিধা কাটিয়ে পাথুরে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কিছু জায়গায় পার হতে হলো কোমর পানি। বৃষ্টি হলে এই পথের অবস্থা তাই সহজেই অনুমেয়। প্রায় দেড় ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে ঝরনার কাছে পৌঁছালাম। পাথুরে নির্জনতায় কিছু সময় কাটিয়ে ফেরার পথে রওনা হলাম। চেনা পথ হওয়াতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম চা বাগান এলাকায়।
বেশ বেলা হয়ে গেছে। পরিশ্রমে ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ। এসেই ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় বদলে খাবারের দোকানে ঢুকলাম। জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া শেষে চা পানও হলো। অতঃপর সেখান থেকে চট্টগ্রাম না ফিরে হেয়াখু, বারোইয়ার হাট, ফেনী হয়ে ঢাকার পথে রওনা হলাম।
হাজারিখিল যেতে হলে
চট্টগ্রাম থেকে হাজারিখিল যেতে হলে মুরাদপুর অথবা অক্সিজেন থেকে ফটিকছড়ির বাসে উঠতে হবে। ভাড়া আনুমানিক ৪০-৫০ টাকা। বাস ছাড়াও সিএনজিতেও ফটিকছড়ি যাওয়া যায়। ফটিকছড়ি থেকে হাজারিখিল বাজার পর্যন্ত সিএনজি যায়। লোকজন কম হলে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে আসতে হবে। রিজার্ভ ভাড়া পড়বে ১৮০-২০০ টাকার মতো। এ ছাড়া চট্টগ্রাম শহরে না ঢুকে বারৈয়ার হাট নেমে সেখান থেকে হেয়াখু বাজার, ফটিকছড়ি হয়েও হাজারিখিল আসা যায়।
হাজারিখিলের গেটে কোনো এন্ট্রি ফি নেই তবে গার্ডরা অনেকক্ষেত্রে কিছু বখশিশ দাবি করে থাকে। এখানেই দুপুরের খাবার ব্যবস্থা আছে। খরচ পড়বে ১৩০-১৫০ টাকা। ক্যাম্পিং করতে চাইলে তাবু, জ্বালানি, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষই সহায়তা করবে। এ ছাড়া ট্রেইলে পথ প্রদর্শনের জন্য গাইড নিতে পারবেন। খরচ পড়বে ৩০০-৫০০ টাকার মতো।
সর্বোপরি যেখানেই ভ্রমণে যাবেন দয়া করে লক্ষ রাখবেন প্রাকৃতিক পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়।