তাজমহল ও আগ্রা ফোর্টের সৌন্দর্য
এক তাজমহল যাব যে গড়ে।
তোমার প্রেমের সমাধিকে নিয়ে।।
ভালবাসার জোনাকি জ্বলে
ভীরু আশার আকাশ তলে।…….(আধুনিক বাংলা গান)
প্রেমের উপমা দিতে প্রেমিক যেমন ভুল করেন না তাজমহলকে কল্পনায় আনতে, তেমনি গল্প, কবিতা, উপন্যাসেও লেখকরা ভুলেন না তাজমহলের কথা টানতে। তাই তাজমহল নিয়ে লেখা খুঁজতে গেলে হয়তো সে তালিকা বেশ দীর্ঘ হবে। কিন্তু যে তজমহল নিয়ে এত কিছু তা নিজ চোখে দেখার প্রত্যাশা কার মনে না জাগে। সেই স্বপ্ন পূরণে বরফের দেশ মানালি ভ্রমণ শেষ করে ছুটলাম আগ্রার পথে। মানালি থেকে আগ্রা বেশ দূরের পথ, প্রায় সাড়ে সাতশ কিলোমিটার। তাই সকাল সকাল রওনা দেওয়া। তবে যারা দিল্লি থেকে সরাসরি আগ্রা যাবেন তাঁদের জন্য পথটা ছোট করে এনেছে ভারতের অনবদ্য সৃষ্টি যমুনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে। দেখার মতো এই সড়ক দিল্লি আর আগ্রাকে সংযুক্ত করেছে মাঝে কোনো বিরতি না দিয়েই। এ সড়কেই মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ‘কার রেস’ মানে গাড়ির প্রতিযোগিতা। আর এই এক্সপ্রেস হাইওয়েতে দিল্লি থেকে আগ্রা পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। যাওয়ার পথে মাঝে মাঝেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে পেখম মেলা ময়ূর। এরা যেনে আপনাকেই আমন্ত্রণ জানাতে সেঁজে বসে আছে। আয়তনে অনেক বড় হওয়ায় এবং ভৌগোলিক নানা পরিবর্তনের কারণে ভারতের একেক রাজ্যের প্রকৃতি একেক রকম। তাই বছরের একই সময়ে কোথাও শীত তো কোথাও গরম। যারা আগ্রা ভ্রমণে আগ্রহী তাদের অবশ্যই গরমকে সঙ্গী করে নিয়েই দেখতে হবে সবকিছু। তবে সে গরম শীতলতায় পরিণত হয় তাজমহল আর আগ্রা ফোর্টের সৌন্দর্যের কাছে। আগ্রা পৌঁছেই প্রথমে হোটেল নিশ্চিত করুন, তারপর শরীরের ক্লান্তি দূর করে চলে যান স্বপ্নের তাজমহল দেখতে।
তাজমহল কীভাবে হলো
তাজমহল সম্রাট শাহজাহানের এক অমর সৃষ্টি। এটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম মমতাজকে ভালোবেসে। আর এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভালোবাসার নিদর্শন যা নির্মাণ করতে সুদক্ষ ২০ হাজার শ্রমিকের সময় লেগেছিল ২২ বছর। সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রীকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, সাম্রাজ্যের সব কাজের সঙ্গী করতেন তাঁকে। এমনকি সামরিক অভিযানের সময় পর্যন্ত বাদ পড়ত না। ১৬৩০ সালে এক সামরিক অভিযানের সময় শেষ সন্তানের আগমনবার্তা মমতাজকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়। আর সে সময়ই মমতাজ স্বামী শাহজাহানের কাছ থেকে যে চারটি প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হলো তিনি যেন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার এমন এক নিদর্শণ নির্মাণ করেন যা পৃথিবীতে আর কেউ কোনোদিন করতে পারবে না। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থেই সম্রাট শাহজাহান ১৬৩১ সালে স্ত্রীর সমাধীতে এই সৌধ নির্মাণ শুরু করেন। দীর্ঘ ২২ বছরের দক্ষ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৬৫৩ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। আর এর নির্মাণের মধ্য দিয়ে স্ত্রীকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতিও রক্ষা হয়েছে। কারণ আজ পর্যন্ত ভালোবাসার এমন নিদর্শন যেমন কেউ তৈরি করতে পারেনি পৃথিবীতে তেমনি নিজের প্রেমিকাকে ভালোবাসতে শাহজাহান-মমতাজের ভালোবাসাকে একবার স্মরণ করতেও ভুল করেন না কোনো প্রেমিক।
তাজমহলে যা যা দেখবেন ও টিকেট
তাজমহল হলো পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি আর ভারতের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র। মহা স্মৃতির এই নিদর্শন দেখতে তাই আপনাকে অবশ্যই কিছু অর্থ খরচ করতে হবে। মনে রাখবেন তাজমহল দেখতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে আপনার আইডি কার্ড। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এটি হলো তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আর অন্য দেশের দর্শনার্থীদের জন্য বৈধ পাসপোর্ট। টিকেট কেনার সময় আপনার পাসপোর্ট দেখিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করেই তবে মিলবে সেই স্বপ্নের তাজমহলের প্রবেশাধিকার। তাজমহলে প্রবেশের টিকেট ভারতীয়দের জন্য ৫০ রুপি হলেও বাংলাদেশিদের প্রবেশ টিকেট ৫০০ রুপি আর এশিয়ার বাইরে থেকে আগত অতিথিদের গুনতে হবে এক হাজার রুপী। তবে দেশীয় দর্শনার্থীদের মূল বেদিতে উঠতে পায়ের জুতা খুলতে হলেও যেহেতু আপনি বিদেশি অতিথি তাই আপনার জন্য রয়েছে জুতার উপরে পরিধান যোগ্য বিশেষ মোড়ক আর গরমে যেন হাপিয়ে না উঠেন তাই বোতলজাত পানি। টিকেটের সাথে মনে করে অবশ্যই এগুলো নিয়ে নেবেন।
তারপর মূল গেইট ধরে এগিয়ে যান। তাজমহল বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। গেইট থেকে ফটকে যেতে আপনাকে খানিকটা পথ হাঁটতে হবে। তারপর মূল বেদিতে উঠতে চমৎকার ২১টি সিঁড়ি অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। সে পথ ধরেই সামনে এগিয়ে যান, আর বিস্মিত হতে থাকুন তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে। কী তার নির্মাণশৈলী! শুভ্র মার্বেল পাথরের গায়ে খোদাই করা কারুকার্য। সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা রঙিন পাথর দিয়ে করা নকশা। যার মধ্যে ইয়াশম, লাল, হলুদ ও বাদামি পাথর আনা হয়েছে পাঞ্জাব থেকে, সবুজ পাথর আনা হয়েছে চীন থেকে, বৈদূর্য মণি ও সবুজ-নীলাভ রত্ন আনা হয়েছে তিব্বত থেকে, নীলকান্ত মনি আনা হয়েছে আফগানিস্তান থেকে, উজ্জ্বল নীল রত্ন আনা হয়েছে শ্রীলঙ্কা থেকে এবং রক্তিমাভ, সাদা ও খয়েরি রঙের মূল্যবান পাথর আনা হয়েছে সৌদি থেকে। সাদা মার্বেলের ওপর মোট আট রকমের মূল্যবান পাথর দিয়ে করা হয়েছে নকশা। আর এই বিশাল নির্মাণকাজে মানুষের পাশাপাশি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এক হাজারের ওপর হাতি। কিন্তু শাহজাহানের এই অনবদ্য কীর্তি তিনি নিজেই বেশিদিন দেখতে পারেননি। তাঁর শেষ জীবনের অজানা সেই কষ্টের কথা জানতে আপনাকে যেতে হবে তাজমহল থেকে ২.৫ কিলোমিটার দূরে যমুনার তীরেই অবস্থিত সম্রাট আকবরের তৈরি ষোড়শ শতাব্দীর আরেক নিদর্শণ আগ্রা ফোর্ট।
আগ্রা ফোর্ট
তাজমহল থেকে আগ্রা ফোর্ট যেতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। প্রবেশ মূল ৮০ রুপি। তবে মূল গেইট থেকে ৫০ রুপির একটি টিকেটের সাথে পাশের আরেকটি বুথ থেকে ৩০ রুপির সংযুক্তি টিকেট নিয়ে নিতে হবে। তারপর এগিয়ে যান ফোর্টের ভিতরে। তাজমহল দেখতে এসে আগ্রা ফোর্ট দেখতে কেউই ভুল করেন না। কারণ এখানেই জড়িয়ে রয়েছে সম্রাট শাহজাহানের সেই দুঃখ গাঁথা। জীবনের শেষ আটটি বছর শাহজাহানকে এখানেই বন্দি থাকতে হয়েছে। আর সেই বন্দিদশা তাও আবার নিজেরই সন্তান আওরঙ্গজেবের হাতে। দীর্ঘ আটটি বছর শুধু প্রিয়তমার কররের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন শাহজাহান। আগ্রা ফোর্ট ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। এর নির্মাণশৈলী দেখার মতো। দুর্গের ভেতরে রয়েছে অনেক প্রাসাদ, মিনার ও মসজিদ। ষোড়শ শতাব্দীতে আকবরের শাসনামলে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আওরঙ্গজেবের শাসনামলে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। দুর্গের ভেতরে খাস মহল, শীশ মহল, মুহাম্মান বুর্জ (একটি অষ্টভুজাকৃতির মিনার), মোতি মসজিদ এবং নাগিনা মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
কোথায় থাকবেন
আগ্রাতে বিভিন্ন মানের ও বিভিন্ন দামের বহু হোটেল রয়েছে। আপনি এগুলো পেয়ে যাবেন আপনার সাধ ও সাধ্যের মধ্যে। যেহেতু আগ্রার তাপমাত্রা বেশি, তাই প্রায় সব হোটেলেই এসিরুম রয়েছে। আগ্রা থাকতে তিন তারকা হোটেলে খরচ পড়বে এক হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ রুপির মধ্যে। তবে যেহেতু পৃথিবীর সব দেশ থেকেই এখানে প্রচুর দর্শনার্থী প্রতি বছর বেড়াতে আসেন, তাই বহু পাঁচতারকা হোটেল রয়েছে এখানে। একটু ব্যয় করলে আপনিও হয়ে যেতে পারেন তাদের একটিতে অতিথি। হোটেল মনিরাম প্যালেস, হোটেল তাজ রিসোর্ট, হোটেল তাজ প্লাজা উল্লেখযোগ্য। তাজমহলে বছরে দুই থেকে তিন মিলিয়ন পর্যটক আসেন বেড়াতে, এর মধ্যে দুই লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক।
আগ্রা ভ্রমণে যা মনে রাখবেন :
- আগ্রার তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় অবশ্যই এসিরুম নিয়ে নিন।
- তাজমহল দেখতে ভুল করে পাসপোর্ট রুমে ফেলে গেলে চলবে না।
- বেড়াতে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের সাথে নম্র ব্যবহার করুন।
- মনুমেন্ট দেখতে গিয়ে অবশ্যই টিকেট কিনতে হবে এবং ঘুরে দেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা সঙ্গে রাখুন। যেকোনো প্রয়োজনে তা আবার দেখাতে হতে পারে।
- মনুমেন্টের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন।
- তাজমহল ও আগ্রা ফোর্ট অনেক জায়গাজুড়ে হওয়ায় প্রয়োজনে গাইডের সহায়তা নিন।
- রাস্তার পাশের খাবার থেকে বিরত থাকুন ও বেশি বেশি পরিষ্কার পানি পান করুন।