সুন্দরবনের কটকা সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার উপায় ও ভ্রমণ খরচ
বঙ্গোপসাগরের ফেনিল প্রান্তরে ‘ব’ আকৃতির দ্বীপের প্রাণকেন্দ্রে এক টুকরো বাংলাদেশের নাম সুন্দরবন। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটি সারা বিশ্বের কাছে এর প্রাকৃতিক নৈসর্গ ও অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত। যতই গভীরে যাওয়া যায়, বনটি তার রহস্য ঘেরা নান্দনিকতা ততই যেন মেলে ধরে। তেমনি এক অত্যাশ্চর্য এলাকা কটকা, যার আদিম প্রকৃতি ও রোমাঞ্চের অভূতপূর্ব সন্নিবেশ বিমোহিত করে পর্যটকদের। চলুন, সুন্দরবনের কটকা সমুদ্র সৈকত এলাকাটিতে ভ্রমণ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
সুন্দরবনের কটকা সৈকতের ভৌগলিক অবস্থান
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা খুলনার কয়রা উপজেলার কয়রা ইউনিয়নের একটি উপকূলবর্তী এলাকা কটকা। সুন্দরবনের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকতটি সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণগুলোর একটি। মোংলা বন্দর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগর ঘেষা কটকা অভয়ারণ্য সুন্দরবন ইকো-ট্যুরিজমের প্রাণকেন্দ্র।
কটকার ইতিহাস
বিগত দশকে সুন্দরবনের ভূতাত্ত্বিক কাঠামো নিয়ে একটি গবেষণা করে জার্মানির ব্রেম্যান বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণায় এই কটকা অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায় বহু যুগ আগের লবণ তৈরির কয়েকটি চুল্লি ও পাত্র। এগুলোর মধ্যে একটির বয়স এক হাজার বছর, তিনটির ২৫০ থেকে ৩০০ বছর, এবং দুটির ৬০০ বছর।
কটকায় আরও পাওয়া যায় টাইগার হিল নামের একটা ঢিবি। যেখানে ছিল পানি পরিশোধনের ছাঁকনি এবং বর্জিত পানি নিষ্কাশনের নালা। গবেষকদের মতে, এটি মূলত লবণ তৈরির উন্নত প্রযুক্তির নিদর্শন। ২৫০ থেকে এক হাজার বছর আগে এখান থেকে উৎপাদিত লবণ রপ্তানি করা হতো ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ায়।
কটকার সমুদ্র সৈকত কটকাবাসীদের কাছে জামতলা সমুদ্র সৈকত নামেই অধিক পরিচিত।
ঢাকা থেকে সুন্দরবনের কটকা সমুদ্র সৈকত যাওয়ার উপায়
সুন্দরবনের গহীনে অবস্থিত হওয়ায় কটকা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য নৌপথ ব্যবহার করতে হয়। ঢাকা থেকে প্রথমে চলে যেতে হবে খুলনা বা বাগেরহাট জেলায়। খুলনা থেকে রুপসা অথবা বাগেরহাটের মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা থেকে সুন্দরবনগামী নৌযানগুলো কটকা নিয়ে যায়।
ঢাকার সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে খুলনা বা সরাসরি বাগেরহাটগামী বাস পাওয়া যায়। এগুলো সাড়ে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বাসের কোম্পানি ও মানভেদে ভাড়া নিতে পারে ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এসি কোচের টিকেটের দাম ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া সেমি চেয়ার কোচ ননএসি বাসগুলো ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে সরাসরি মোংলায় পৌঁছে দেয়। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে বাসে করে খুলনা বা মোংলায় যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা।
যারা ট্রেনে যেতে চান, তাদেরকে কমলাপুর থেকে খুলনাগামী ট্রেনে উঠতে হবে। সিটের ধরণভেদে ভাড়া পড়তে পারে ৫০৫ থেকে ২ হাজার ১৬৮ টাকা।
দ্রুত যাতায়াতের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট হচ্ছে আকাশপথ। এর জন্য প্রথমে বিমানে ঢাকা থেকে যশোর যেতে হবে। এখানে মানভেদে বিমান ভাড়া বাবদ খরচ হতে পারে ৪ হাজার ২১৮ থেকে ৪ হাজার ৯০৮ টাকা। অতঃপর এয়ারলাইন্সের বাসে যশোর থেকে খুলনা যাওয়া যাবে। তবে বিকল্প হিসেবে গাড়ি রিজার্ভ করে সরাসরি মোংলা পর্যন্ত যাওয়া যায়। আর ইন্টারসিটি বাসে গেলে যশোর থেকে প্রথমে খুলনা, তারপর বাস বদল করে আরেক বাসে খুলনা থেকে মোংলা যেতে হবে।
মোংলা বন্দর থেকে নেওয়া নৌযান কটকা খালের পশ্চিম পাড়ের জেটিতে নামিয়ে দেবে। জেটি থেকে উপরে উঠলেই দেখা যাবে বন কার্যালয়। সেখান থেকে খানিকটা পশ্চিম দিকে হেঁটে গেলেই পড়বে ইট বাঁধানো রাস্তা, যেটি সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে সমুদ্রে।
সুন্দরবনের কটকা ভ্রমণে যা যা দেখবেন
পর্যটকদের জন্য কটকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কটকা অভয়ারণ্য। কেননা এখান থেকে নিরাপদেই দর্শন পাওয়া যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। এমনকি সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় পাখি হিসেবে পরিচিত মদনটাক দেখার জন্য উপযুক্ত স্থান হচ্ছে এই কটকা। এ ছাড়াও চোখে পড়বে চিত্রা হরিণের দল, বানর, বনবিড়াল, উদবিড়াল, বন মোরগ, এবং বন্য শুকর। শীতকালে অতিথি পাখির পাশাপাশি ভীড় করে নানান প্রজাতির পাখি। সেই সঙ্গে দেখা যাবে লোনা পানিতে কুমিরের রোমাঞ্চকর দৃশ্য।
এখানে বন বিভাগের অধীনে পরিচালিত একটি রেস্ট হাউস আছে। খুব কাছেই একটি কাঠের জেটি থাকায় লঞ্চ থেকে নেমে কিছু দূর হাঁটলেই রেষ্ট হাউসে প্রবেশ করা যায়। রেস্ট হাউসের আশেপাশে এঁকেবেকে ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি ছোট বড় খাল। এগুলোতে নৌকা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভেসে বেড়ানো যায়। এ সময় মাঝে মধ্যে শোনা যায় বাঘের গর্জন।
বন বিভাগ কার্যালয়ের পেছনে সোজা পশ্চিমমুখী কাঠের তৈরি একটি ট্রেইল রয়েছে। এর উত্তর পাশের খালে ভাটার সময় দেখা যায় সুন্দরী গাছের ঘন শ্বাসমূল। ট্রেইলটির উত্তরে কেওড়া বনের ভেতরে ঢোকার সময় সন্তর্পণে হাঁটতে হবে। কেননা খুব কাছেই দেখা পাওয়া যাবে অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রা হরিণের।
ট্রেইলের পূর্ব দিকটায় রয়েছে ঘন বন আর মিঠা পানির পুকুর। এই পুকুরই এখানকার স্থানীয়দের পানির একমাত্র উৎস। ঘন বনের দক্ষিণে হেঁটে গেলে পরপর তিনটি টাইগার টিলা পড়বে। এই টিলাগুলো দেখে নিমেষেই শরীরে শিহরণ বয়ে যেতে পারে, কেননা এগুলোতে প্রায়ই বাঘের পায়ের ছাপ থাকে।
কটকার আরও একটি জনপ্রিয় স্থান হচ্ছে এর ৪০ ফুট উঁচু চারতলা বিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ারটি। স্থানীয়দের কাছে এটি জামতলা ওয়াচ টাওয়ার নামে পরিচিত। এখান থেকে জীববৈচিত্র্যসহ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়।
এই টাওয়ারের পরে উত্তরে পথটি সোজা গিয়ে মিশেছে জামতলা সমুদ্র সৈকতে। সৈকতটি বেশ পরিচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি। বেলাভূমি জুড়ে যতদূর চোখ যায় শুধুই কাঁকড়াদের আঁকিবুকি। পূর্ব দিকে সৈকতের শেষ প্রান্তরেখা যুক্ত হয়েছে কচিখালি এলাকায়।
সুন্দরবনের কটকা সৈকত ভ্রমণের সেরা সময়
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস তথা শীতের মৌসুম কটকা ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময়। সমুদ্র শান্ত থাকার কারণে এ সময় আশেপাশের প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে পায়ে হেঁটেই ঘুরে বেড়ানো যায়। খুলনা ও মোংলা থেকে বেশ দূরে এবং সুন্দরবনে গহীনে হওয়ায় আর্দ্র মৌসুমে কটকা যাওয়ার পথ যথেষ্ট দুর্গম হয়ে ওঠে। তাছাড়া খাল, নদী ও সাগরে নৌকা ভ্রমণের জন্য শীত ঋতু তুলনামূলক অধিক নিরাপদ।
সুন্দরবনের কটকা ভ্রমণ খরচ
স্পিডবোটে করে কটকা যেতে খরচ হতে পারে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা। সেখানে ট্যুরিস্ট বোটের সম্ভাব্য খরচ এক থেকে দুই হাজার টাকা। বন বিভাগের মাধ্যমে অভয়ারণ্য ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট ভ্রমণ ফি নির্ধারিত রয়েছে। জনসাধারণের জন্য এই ফি দিন প্রতি ১৫০ টাকা এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য ৩০ টাকা। অভয়ারণ্যের শুধু বাইরেটা ঘুরে দেখার জন্য ফি ৭০ টাকা, যেটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাখা হয় ২০ টাকা।
এ ছাড়াও রয়েছে গাইড ভাড়া দিন প্রতি ৫০০ টাকা, নিরাপত্তা গার্ডের খরচ ৩০০ টাকা, লঞ্চ ক্রু ফি ৭০ টাকা, টেলিকমিউনিকেশন খরচ ২০০ টাকা, এবং ভিডিও ক্যামেরা ফি ২০০ টাকা।