আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারই ভিয়েনা সংলাপের লক্ষ্য : ইরান
ইরান তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার চায়। আসন্ন ভিয়েনা সংলাপে এটাই ইরানের লক্ষ্য বলে জানালেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদে। তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা এমনভাবে প্রত্যাহার করতে হবে, যাতে তা যাচাই করার সুযোগ থাকে। ইরানি সংবাদ সংস্থা এমইএইচআর এ খবর জানিয়েছে।
ভিয়েনা আলোচনা সফল হলে যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারে বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এ কথা বলেন খাতিবজাদে।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় আগামী ২৯ নভেম্বর পরমাণু সমঝোতা পুনরুজ্জীবনের আলোচনা আবার শুরু হতে যাচ্ছে।
খাতিবজাদে বলেন, সব নিষেধাজ্ঞা একসঙ্গে প্রত্যাহার করতে হবে এবং এ ব্যাপারে কার্যকর গ্যারান্টিও থাকতে হবে।
খাতিবজাদে আরও বলেন, ভিয়েনা সংলাপে ইরানের মূল লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা। শুধু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার লক্ষ্যে ইরান ভিয়েনা সংলাপে যোগ দিচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত একটি পরমাণু চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় ইরান এবং বিশ্বের ক্ষমতাধর কয়েকটি শক্তি আগামী ২৯ নভেম্বর ভিয়েনায় আলোচনায় বসছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর সম্ভাব্য হামলার জন্য ইসরায়েল তার সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে এরই মধ্যে ১৫০ কোটি ডলার বরাদ্দ রেখেছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যাপারে তেহরানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও তেহরান সবসময় তা অস্বীকার করে আসছে।
ইরান বলছে, শক্তিধর বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আগের চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা হলে সেটিকে তারা স্বাগত জানাবে। ওই চুক্তিতে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা সাপেক্ষে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে কিছু সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
ভিয়েনার আলোচনা সফল হলে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে। এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ইরানের সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরমাণু সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। আর, আলোচনা ব্যর্থ হলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিপজ্জনক পথে মোড় নিতে পারে।
কী আছে মূল চুক্তিতে?
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তিটি হয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ জার্মানির সঙ্গে। এ পক্ষগুলো ‘পি৫+১’ হিসেবে পরিচিত।
সমঝোতায় ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি ও মজুদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। চুক্তি অনুসারে তেহরান তাদের কিছু পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করতে অথবা পরিবর্তন করতে সম্মত হয়। এ ছাড়া ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতিও দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, ইরানের ওপর আরোপিত অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। পি৫+১ বিশ্বাস করেছিল যে, এ চুক্তি পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা থেকে ইরানকে প্রতিহত করবে। ইরান এ ধরনের চেষ্টার কথা সবসময় অস্বীকার করেছে। কিন্তু, বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা ইরানের বিরুদ্ধে এ ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখার অভিযোগ এনেছে।
ইরান আশা করেছিল—নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে তাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এ সমঝোতার ব্যাপারে দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক আলোচনার পর চুক্তিটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে কার্যকর হয়।
চুক্তিটি কেন নির্জীব হয়ে পড়ল?
ছোট্ট করে এর উত্তর হচ্ছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
পরমাণু চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল আরেক সাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে। কিন্তু, নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে আসার অনেক আগেই ট্রাম্প পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মনে করেন, ‘এটি তাঁর দেখা সবচেয়ে খারাপ চুক্তি।’
ট্রাম্প বারবারই এ সমঝোতাকে ‘বীভৎস’ ও ‘হাস্যকর’ বলে উল্লেখ করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা খুবই দুর্বল। তাঁর মতে, এ চুক্তিতে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত ছিল।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে এ চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর জবাবে ইরান চুক্তিতে বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে অধিক মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা কমিয়ে দেয়।
চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করতে চায় কারা?
আপাতদৃষ্টিতে চুক্তিটি যারা সই করেছে, তাদের প্রত্যেকে এটি ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। আর, ইরান কখনও চায়নি এ সমঝোতা বাতিল করা হোক। চায়নি ‘পি৫+১’-এর দেশগুলোও।
একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এ চুক্তিটি বাতিল করতে চেয়েছিল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারাক ওবামার শাসনামলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় চুক্তিটি সমর্থন করেছিলেন। এ ছাড়া ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে চুক্তিটি হওয়ার ব্যাপারে যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইরান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
আলোচনা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
কিছু বাধা-বিপত্তি রয়েছে। চুক্তিটি ভেঙে পড়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্রুদ্ধ ইরান। তারা দেশটিকে একটি ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করছে।
ইরানের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে তাদের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি। কিন্তু, ওয়াশিংটন চায়—ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ বন্ধ করুক। দুটো দেশই চায় অপরপক্ষ যেন আগে তাদের কাজটি করে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইরানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে না।
এ ছাড়া ইরান গত জুনে এব্রাহিম রাইসিকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাইসির সরকারকে আগের সরকারের তুলনায় কট্টরপন্থি বলে মনে করা হয়।
প্রেসিডেন্ট রাইসি বলেছেন, তিনি ভিয়েনার আলোচনাকে প্রলম্বিত হতে দেবেন না। একই সঙ্গে তিনি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং তাদের আঞ্চলিক নীতির ব্যাপারে যেকোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দিয়েছেন। এ নীতির মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থন। এসব কারণে চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার কাজ কিছুটা কঠিন হতে পারে।
চুক্তিটি ফিরে এলে সবাই খুশি হবে?
ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র সৌদি আরব সতর্কতার সঙ্গে পুরোনো চুক্তিটিকে সমর্থন করেছিল। তবে, মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে যাকে মনে করা হয়, যদিও তা কখনও নিশ্চিত করা হয়নি, সেই ইসরায়েল আসলে চুক্তিটির বড় সমালোচক। ইসরায়েল মনে করে—ওই চুক্তি সত্ত্বেও ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার দিকে অগ্রসর হতে পারে।
ইসরায়েল এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের আরও দুটো দেশের পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল বলছে—ইরানকে তারা কখনও পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না।