করোনা মোকাবিলা করে এসডিজি অর্জনে রোডম্যাপের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণ নিশ্চিত করে ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য একটি বৈশ্বিক রোডম্যাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
টেকসই উন্নয়ন নিয়ে ‘নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে’ ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। আর্থ ইনস্টিটিউট, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গ্লোবাল অ্যাসোসিয়েশন অব মাস্টার্স ইন ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক সম্মেলনটির আয়োজন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদেরকে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি সাহসী ও উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক রোডম্যাপ প্রণয়ন করা প্রয়োজন-যাতে কেউ পেছনে পড়ে না থাকে।’
শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে টেকসই উত্তরণের ওপরেই এখন এসডিজির সাফল্য নির্ভর করছে। এখন বিশ্বের সব স্থানে টিকা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি এবং তা অতি জরুরি।’ দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় তিনি বলেন, ‘২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে আমাদের সম্পদের যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে, তা অবশ্যই কমাতে হবে।’
তৃতীয় প্রস্তাবনায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘চলমান বৈশ্বিক মহামারির অভিঘাতের কারণে ১৯৯৮ সালের পর এই প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তার জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। অধিকন্তু, আমাদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনীর ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর চতুর্থ প্রস্তাবনায় বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের বিপর্যয় বা দুর্যোগ মোকাবেলায় জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণকে পূর্ণতা দেবে।’
সর্বশেষ প্রস্তাবনায় শেখ হাসিনা বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ জোরদার করা ও যান্ত্রিক সহায়তার ওপর আরো গুরুত্ব দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সমন্বয় বাড়ানো উচিৎ।’ জরুরি পরিস্থিতি ও বিপর্যয় মোকাবেলায় যথাযথ ও সময়োপযোগী সহায়তা পদক্ষেপ নিশ্চিত করার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী মহামারি ও অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রতিটি স্তরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুতি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন। ২০৩০ এজেন্ডাকে একটি বৈশ্বিক চুক্তি আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘এটি সকলের অন্তর্ভুক্তিতে আমাদের টেকসই বৈশ্বিক উন্নয়নের একটি নীলনকশা। কোনো দেশ একা এই এজেন্ডা অর্জন করতে পারবে না। এই এজেন্ডা অর্জনে আমাদের বৈশ্বিক সহযোগিতা ও সংহতি বাড়াতে হবে। আমরা এরই মধ্যে ডেকেড অব ডেলিভারি এবং অ্যাকশন অব দ্য এজেন্ডাতে প্রবেশ করলেও, লক্ষ্য এখনো দূরেই রয়ে গেছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমনকি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির আগেও অনেক দেশ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে ছিল না। এই মহামারি তাদেরকে সেই পথ থেকে আরও পিছিয়ে দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ বিশ্বকে হতাশ করেছে। এই বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারি বহু মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি এর কারণে অসংখ্য মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে। মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে ও ক্ষুধার্ত রয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহামারির কারণে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, বিশেষত শিশুদের শিক্ষা।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি এই মহামারিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে আমাদের উন্নয়নের অর্জন ও এসডিজিএস অগ্রগতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন প্রচেষ্টায় পথিকৃত। আমরা সম্প্রতি একটি উচ্চাভিলাষী ও আধুনিক এসডিজি পেশ করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা সবুজ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন, লবণাক্ততা, সহিষ্ণুতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়ে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’ করেছি।”
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট-২০২১-এর বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে এসডিজি সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে প্রথম পাঁচটি দ্রুততম অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশের মধ্যে অন্যতম এবং জিডিপিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। জাতিসংঘ এ বছর বাংলাদেশকে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি দিয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে আমরা আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালায় এজেন্ডা ২০৩০ অঙ্গীভূত করতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। এসডিজি বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে ২০১৭ এবং ২০২০ সালে দুটি ভিএনআর জমা দিয়েছি। আমরা আমাদের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট খাত ভিত্তিক মূল্যায়ন এবং সমন্বিত এসডিজি করেছি। আমাদের দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনাও এসডিজির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তারা ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্য-আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ-আয়ের দেশে রূপান্তরিত করার কল্পনা করছে। ডেল্টা-প্ল্যান ২১০০ গ্রহণ এসডিজি ভিশন এবং এর অধিকতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর লক্ষ্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপক বদ্বীপ তৈরি করা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সমাজের সামগ্রিক সম্পৃক্ততা’ নিশ্চিত করতে সরকার বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য অংশীদারদের নিয়ে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। যারা সবচেয়ে পেছনে রয়ে গেছে তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এসডিজি স্থানীয়করণে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা এসডিজি ট্র্যাকার চালু করেছি। এটি আমাদের এসডিজিগুলোর বাস্তবসম্মত অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ডেটা স্টোরহাউস হিসাবে কাজ করে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে অবকাঠামোগত সক্ষমতায় প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমরা পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল, কর্ণফুলি টানেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা অবকাঠামো প্রকল্প চালু করছি। জাতীয় উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীদের মূলধারার মধ্যে রাখা হয়েছে এবং তারা এখন রপ্তানি পোশাক খাতের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের মেরুদণ্ড।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ডিজিটাইজেশন ও সংযোগে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ডিজিটাল অর্থনীতি, তরুণদের নেতৃত্বে উদ্ভাবন এবং রূপান্তরমূলক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনকে উৎসাহিত করেছে। এটি এখন আমাদের কোভিড-১৯ মহামারিকে আরও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সহায়তা করছে। আমাদের তরুণদের সংখ্যা প্রচুর। ডিজিটাল অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সর্বাধিক সুবিধা পেতে তাদের সহায়তা করার জন্য আমরা তাদের শিক্ষা এবং দক্ষতা বিকাশে প্রচুর বিনিয়োগ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৩০ সালের এজেন্ডা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অর্জনের পথে ফিরে আসার বিষয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনার সুযোগের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নীতি নির্ধারক হিসেবে বিশ্ব উন্নয়ন আলোচনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। আমি ২০০০ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলনে, ২০৩০ সালের যুগান্তকারী এজেন্ডা গ্রহণ এবং ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি গ্রহণে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছি। এমডিজিতে আমাদের সাফল্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সাফল্যের জন্য একটি ‘অলৌকিক উন্নয়ন’ হিসাবে স্বীকৃত দিয়েছে, বিশেষ করে দারিদ্র হ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লিঙ্গ অগ্রাধিকার, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, লিঙ্গ সমতা ইত্যাদি।”
সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত এক দশকে আমাদের দারিদ্রের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে এবং আমাদের মাথাপিছু আয় তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭ ও মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৩ জন হ্রাস পেয়েছে এবং জীবনের দীর্ঘায়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তারা মূলত নারী এবং শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা প্রদানের জন্য ১৮ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। ডব্লিউইএফ-এর মতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে। নারী শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এবং দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা বাংলাদেশে বিনামূল্যে করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি পাচ্ছে। উপবৃত্তির অর্থ সরাসরি তাদের মোবাইলের মাধ্যমে মা বা বৈধ অভিভাবকদের কাছে পৌঁছায়। প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি এবং বৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে ২০টি নতুন পাবলিক টেকনোলজিক্যাল এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ফলে মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২টিতে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বালিকা-বালক স্কুল তালিকাভুক্তির অনুপাত ২০০৯ সালে ৩৫:৬৫ থেকে ২০১৭ সালে ৫৩:৪৭ এ উন্নীত হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে তালিকাভুক্তি ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান নারী শিক্ষা বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে এবং বিদ্যালয়ের মধ্যাহ্নভোজনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থী ঝড়েপড়া ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের এসডিজি যাত্রা এই সাফল্যগুলোর ওপর নির্ভর করে।’