ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছে বীর দাসের ৭ মিনিটের ভিডিও
‘দুরকম ভারত’ কিংবা বলা যায়—একই ভারতের দুই রূপের কথা তুলে ধরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়েছেন ভারতীয় স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান বীর দাস।
গত রোববার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় সাত মিনিটের একটি ভিডিও শেয়ার করেন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার কৌতুকশিল্পী বীর দাস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি’র জন এফ কেনেডি সেন্টার ফর দ্য পারফরমিং আর্টসে নিজের পারফরম্যান্সের ভিডিওটি শেয়ারের পর বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। ভাইরাল হয়েছে বীর দাসের সে ভিডিও। ভিডিওটি দেখে বেশির ভাগ লোকজন বলছেন—বীর দাস ভারতের বাস্তবচিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন—নিজের দেশকে অপমান করেছেন বীর দাস।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, বীর দাসের আলোচিত ভিডিওর শিরোনাম—‘আই কাম ফ্রম টু ইন্ডিয়াস’।
জন এফ কেনেডি সেন্টারে নিজের পারফরম্যান্সের ওই ভিডিতে শোনা যায় বীর দাস বলেছেন, ‘আমি এমন ভারত থেকে এসেছি—যেখানে দিনে নারীর পূজা করা হয়, আর রাতে গণধর্ষণ। আমি এমন ভারত থেকে এসেছি—যেখানে ছোটরা মাস্ক পরে একে অন্যের সঙ্গে হাত মেলায়, আর নেতারা মাস্ক ছাড়া একে অপরকে আলিঙ্গন করেন৷ আমি এমন ভারত থেকে এসেছি—যেখানে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা বাতাসের মান) ৯০০০, তার পরেও আমরা খোলা আকাশের নিচে ঘুমাই, আর আকাশে তারা দেখি৷ আমি এমন এক ভারত থেকে এসেছি—যেখানে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ৩০ বছরের নিচে, তা সত্ত্বেও আমরা ৭৫ বছর বয়সি নেতাদের মুখে দেড়শ বছরের পুরোনো তত্ত্বের কথা শুনি৷ আমি এমন ভারত থেকে এসেছি—যেখানে পিএম কেয়ার্স নিয়ে কোনো তথ্য পাই না৷ আমি এমন ভারত থেকে এসেছি—যেখানে আমরা নিজেদের নিরামিশাষী বলে গর্ববোধ করি, আর সেই শাক-সবজি চাষ করা কৃষকদের পিষে মারি/গাড়িচাপা দিই৷’
ছয় মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের ভিডিওতে ভারতের রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের মতো নানা ইস্যু তুলে ধরেছেন বীর দাস। ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচের পর যেভাবে ক্রিকেট দলের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, সে কথাও নিজের তুলে ধরেন বীর। তিনি বলেন, ‘আমি এমন ভারত থেকে এসেছি—যেখানে আমরা সবুজের সঙ্গে খেলার সময় নীল হয়ে যাই। আর, যখনই সবুজের কাছে হারি—কমলা (হয়ে যাই)।’
ভিডিও শেষদিকে বীর দাস বলেন, ‘কিন্তু, আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে বলতে পারি—আমি সেসব মানুষকে তুলে ধরছি, যারা একটা দারুণ জিনিস (ভারত) তৈরি করেছে, কিন্তু যা বর্তমানে স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে।’
বীর দাসের ভিডিওটি প্রকাশের পর তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ভারতের রাজনৈতিক মহলের অনেকে। শুধু তা-ই নয়, গতকাল বুধবার বীর দাসের ঘটনা ঘিরে তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লি বিজেপির মুখপাত্র আদিত্য ঝা দিল্লির একটি থানায় অভিযোগ (এফআইআর) করেছেন।
আদিত্য ঝা টুইটে লিখেছেন, ‘অন্য দেশে গিয়ে আমাদের জাতিকে কেউ অপমান করবে, তা সহ্য করা হবে না।’ পাশাপাশি তিনি বীর দাসকে গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছেন।
এখানেই শেষ নয়—বীর দাসের সমালোচনা করেছেন বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঙ্গনা লিখেছেন, ‘আপনি যখন ভারতীয় পুরুষদের গণধর্ষণকারী হিসেবে তুলে ধরছেন, তখন বাইরে আপনাকে এ কথার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
বীর দাসকে আক্রমণ করেছেন বহু টুইটার ব্যবহারকারী। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, বীর দাস ‘আমরা’ বলে যাদের কথা বলতে চেয়েছেন, তারা কারা? এ ধরনের সরলীকরণ করায় অনেকে তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছেন। অনেকে আবার দ্বিমত পোষণ করে বলছেন—বীর দাস রাজনীতি, ধর্ম ও ক্রীড়ার মতো বহু খাতে ভারতের দ্বিচারিতার চিত্র তুলে ধরেছেন। অনেকে আবার বীরের সাহসী মনোভাবের প্রশংসা করেছেন।
এদিকে, ভিডিও শেয়ার করার পর বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক শুরু হলে গত মঙ্গলবার তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখিত বিবৃতি দেন বীর দাস।
বীর দাস জানান, ভিডিওটি আসলে ‘স্যাটায়ার’ বা ব্যাঙ্গাত্মক৷ বীর লেখেন, ‘আমি ইউটিউবে একটি ভিডিও পোস্ট করার পর, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে। বৈসাদৃশ্যময় দুই ধরনের ভারতের দ্বৈত সত্ত্বা বোঝানো হয়েছে ব্যাঙ্গাত্মক এ ভিডিওতে। প্রত্যেক দেশেরই আলোকময় দিক থাকে, আবার অন্ধকারও থাকে, ভালো-মন্দ দুটোই থাকে। এগুলোর কোনোটিই গোপন কিছু নয়৷’
বীর দাস নেটিজেনদের তাঁর পুরো ভিডিও দেখার আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, জন এফ কেনেডি সেন্টারের দর্শক শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে ভারতের প্রশংসায় হাততালি দিয়েছে, কোনো ঘৃণার মনোভাব থেকে নয়৷
বীর দাস লেখেন, ‘ভারতের জন্য লোকজন আশা নিয়ে গলা ফাটায়, ঘৃণা নিয়ে নয়। ভারতের জন্য হাততালি দেয় শ্রদ্ধা থেকে, ছোট করার জন্য নয়। আমি দেশের জন্য গর্বিত। সেটাই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
বীর দাস আরও লিখেছেন, ‘আমরা যে মহান, তা কখনোই ভুলতে পারি না—ভিডিওতে সে কথাই জানানো হয়েছে। আমাদের যা কিছু মহান করে তুলেছে, তার প্রতি মনোনিবেশ করতে ভুলবেন না।’
বীর দাসের এমন বক্তব্যের প্রতি চলচ্চিত্র পরিচালক হানসাল মেহতা এবং অভিনেত্রী রিচা চাড্ডা সমর্থন জানিয়েছেন।
এ ছাড়া বীর দাসের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন কপিল সিব্বল ও শশী থারুরের মতো দুঁদে রাজনীতিবিদেরাও।
কংগ্রেস দলের সদস্য শশী থারুর টুইটারে লিখেছেন, বীর দাস ‘লাখো মানুষের হয়ে কথা বলেছেন।’
শশী থারুর আরও লিখেছেন, বীর দাস এমন “একজন স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান, যিনি জানেন—‘স্ট্যান্ড আপ’ শব্দের আসল অর্থ শারীরিক নয় বরং নৈতিক।”
বীর দাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার মিল রয়েছে। কিছুদিন আগে ভারতের আরেক কৌতুকশিল্পী মুনাওয়ার ফারুকিকে হিন্দু দেবতাদের সম্পর্কে ‘অশালীন মন্তব্য’ করার অভিযোগে এক মাসেরও বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয়েছিল। এ ঘটনায় ফারুকিকে একটি কট্টরপন্থি হিন্দু গোষ্ঠীর হুমকির পরে তাঁর একাধিক অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগজনক কথা উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ—ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের দিকে কেউ আঙুল তুললে তাকে নাজেহাল করা হয়। এবং মোদি সরকার ও বিজেপির সমালোচনামূলক প্রতিবেদন করায় সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করার অভিযোগও সামনে এসেছে।