যেসব ভুল ধারণা না ভাঙলে করোনা মোকাবিলা করা যাবে না
চীন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের আতঙ্ক যেন থামছেই না। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসজনিত রোগ সারানোর সরাসরি কোনো ওষুধ নেই বলে এই আতঙ্ক আরো বেশি করে চেপে ধরছে সবাইকে। আর এসব আতঙ্কের আগুনে ঘি ঢালছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভুল ধারণা বা মিথ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এরই মধ্যে জানিয়েছে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছে তারা।
করোনা নিয়ে কী কী ভুল ধারণা এখনই ভেঙে না ফেললে ভাইরাসটি মোকাবিলা করা যাবে না, জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা এ খবর জানিয়েছে।
চলুন জানা যাক, করোনা নিয়ে ভুল ধারণা বা মিথগুলো কী কী।
হ্যান্ড ড্রায়ারে ঘন ঘন হাত শুকানো
বাইরে থেকে ঘরে এলে বা বাড়িতে থাকলেও ঘন ঘন হ্যান্ড ড্রায়ারের সামনে দাঁড়িয়ে হাত শুকিয়ে নিলেই করোনাভাইরাস এড়ানো যাবে, এমন একটি মিথ এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার হ্যান্ড ড্রায়ার বিক্রিও বেড়েছে গত কয়েক দিনে। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ভুল বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাড়ির বাইরে থেকে এসে ভালো করে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা অ্যালকোহলভিত্তিক কোনো হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে কনুই পর্যন্ত হাত ধুয়ে, পরিষ্কার কোনো তোয়ালে বা গামছায় হাত মুছে নিন। হাত কিছুক্ষণ উঁচু করে রেখে প্রাকৃতিক হাওয়া বা পাখার হাওয়াতেও শুকিয়ে নিতে পারেন।
সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ছড়ানো
করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন ভারতের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্ত। তিনি জানান, অ্যালকোহল বা ক্লোরিন সারা শরীরে স্প্রে করে করোনাভাইরাস আটকানো অসম্ভব। এতে উল্টো ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। এর চেয়ে বরং অ্যালকোহল আছে এমন কোনো হ্যান্ডওয়াশ করোনা ঠেকাতে সাহায্য করে।
চীনা খাবার বা চীন থেকে আসা মানুষ এড়ানো
এমন আচরণ হাস্যকর বলেই মত চিকিৎসকদের। তাঁদের কথায়, কোনোভাবেই চীনা খাবার থেকে করোনা ছড়ায় না। চীনে যে সাপ বা বাদুড় খাওয়ার প্রচলন আছে, তা থেকে করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এসব খাবার খাওয়ার চল নেই। তাই ফ্রায়েড রাইস, চাওমিন বা মোমো খান পেটপুরে, নিশ্চিন্তে।
চীন থেকে কেউ এলেই তিনি করোনাভাইরাস শরীরে বয়ে এনেছেন, এমন ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। করোনার লক্ষণ প্রকাশ পেলেই কেবল কারো কাছ থেকে দূরে থাকুন। অকারণে সুস্থ মানুষের সঙ্গে এমন ব্যবহারের কোনো কারণই নেই।
চীন থেকে আসা পার্সেল না নেওয়া
যেসব ক্ষেত্রে চীন নামটা রয়েছে, তাতেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। অনেকেই ভাবেন, যিনি পার্সেল দিয়েছেন বা চীন থেকে বাংলাদেশে আসতে যত হাত ঘুরে এসেছে এই পার্সেল, তাতে করোনা আক্রান্ত কেউ থাকলেও থাকতে পারেন। এই ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন বলে দাবি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসকদের। বরং তাঁদের মতে, অহেতুক এই ভয় না পেয়ে নিশ্চিন্তে চীন থেকে আসা পার্সেল গ্রহণ করুন। কারণ, করোনাভাইরাসের জীবাণু কোনো জড় পদার্থের ওপর বেশিক্ষণ বাঁচে না।
পোষা প্রাণী থেকে করোনা ছড়ায় কি?
না, ছড়ায় না একেবারেই। দু-একটি ক্ষেত্র বাদে কুকুর, বিড়াল বা পাখির শরীরে এই জাতীয় ভাইরাসের অস্তিত্বের সেভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে পোষা প্রাণীদের সঙ্গে বাইরে বেরোলে বা এদের সঙ্গে বাইরে থেকে খেলাধুলা করে এসে উভয়ই ভালো করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন। হাত-পা ভালো করে ধোওয়া, পোষ্যের প্রয়োজনীয় যত্ন, এগুলো যেকোনো অসুখ থেকেই দূরে রাখবে।
নাক থেকে পানি ঝরলেই করোনা?
এই আশঙ্কার কথা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন ভারতীয় চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। যেকোনো সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা, সর্দি-কাশি মানেই তা করোনাভাইরাস নয়। বরং দীর্ঘদিন নানা ওষুধপত্রেও অসুখ না সারলে, তখন তা ভয়ের কারণ। তখনই ‘পলিমারেস চেন রিঅ্যাকশন’ বা পিসিআর পরীক্ষা করে দেখা হয়, শরীরে এই ভাইরাস ঢুকেছে কি না।
মাস্ক হলেই চলবে?
না, চলবে না। যেকোনো মাস্ক কিন্তু করোনা ঠেকানোর জন্য উপযুক্ত নয়। বরং বাজারের সস্তা মাস্ক থেকে অন্য নানা সংক্রমণ বাড়তে পারে। তা হলে কেমন মাস্ক কার্যকর? চিকিৎসকদের মতে, সাধারণ মাস্ক নয়, তিন স্তরের নীল বা সবুজ রঙের ডিসপোজাল মাস্ক করুন, যা কেবল ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
তিল, তেল ও রসুন করোনা ঠেকায়?
প্রতিদিন সকালে এক কোয়া রসুন শরীরের নানা উপকার করে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, শ্লেষ্মা ঠেকানো—এসব রসুনের ভালো গুণ। তিল ও তেলেরও এমন নানা উপকারী দিক রয়েছে। কিন্তু এদের কোনোটিই করোনাভাইরাস ঠেকাতে পারে না। করোনা প্রতিরোধের কোনো বাড়তি ক্ষমতা এদের আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
শুধু বয়স্ক ও শিশুদের জন্য ভয়ের কারণ?
মোটেই তা নয়। করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও বয়স দেখলেই তা বোঝা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশু ও বয়স্কদের কম থাকে বলে ভয় তাদের বেশি। তার মানে এই নয় যে কেবল শিশু ও বয়স্করাই এর শিকার হতে পারে।
মাংস বাদ?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ গৌতম বরাট বলেন, ‘এসবই মানুষের রটানো ভয়। করোনাভাইরাসের যা প্রকৃতি, তাতে তা নির্দিষ্ট কিছু চীনা বাদুড় ও সাপের মাংস থেকে ছড়াতে পারে। কিন্তু মুরগির মাংসে তা আসতে পারে না। মুরগির শরীরে এই ভাইরাস থাকা অসম্ভব। তবে অসুখ ছড়ালে কিছু বাড়তি সতর্কতা আমরা সব সময় নিতে বলি। তাই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।’
নিয়ম মেনে চলার কথা বললেন ভাইরোলজিস্ট সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর মতে, ‘মুরগির বা খাসির মাংস থেকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথা একেবারেই ভিত্তিহীন। আমরা, উপমহাদেশে যেভাবে মাংস রান্না করি, তাতে যেকোনো ভাইরাসই অত তাপে বাঁচে না। তবে যেকোনো ভাইরাস থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো, রান্নার সময় কিছু নিয়ম মেনে চলা।’