যেভাবে দিল্লিতে ফিরে এলো এএপি
ঐতিহাসিক! হ্যাঁ, এটা ইতিহাসের চূড়ান্ত পুনরাবৃত্তি। অবশেষে দিল্লিতে নির্বাচন হলো; ফলও প্রকাশ পেল। অনেক গুঞ্জনই শোনা গিয়েছিল। অনেক জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান নেতাও এখন অনুতপ্ত। পরাজয়ের যে গুঞ্জন বাতাসে ভাসছিল, তা-ও নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। আম আদমি পার্টি (এএপি) জিতেছে । বিজেপি নিঃশেষ হয়ে গেছে।
আজ থেকে কয়েক মাস আগে আমরা যদি এমন প্রত্যাশা করতাম, তাইলে লোকজন হাসাহাসি করত। আমার এখনো মনে পড়ে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ পরে লোকজন কীভাবে তাঁর (কেজরিওয়াল) মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিত। একদিন কেজরিওয়াল আমাকে বলেছিলেন, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় স্থানীয় এক প্রহরী তাঁকে দেখে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হতে চায়।’
গত সংসদ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ছাড়া বাকি দলগুলোর অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সে সময় এএপি দিল্লির সাতটি আসনে দাঁড়িয়ে সবকটিতেই হেরেছিল। ওই নির্বাচনে এএপি ৪০০টিরও বেশি আসনে প্রতিযোগিতা করেছিল। প্রার্থীরা তাঁদের ৯০ শতাংশ সঞ্চয় হারিয়েছিল। দলটিকে তখন ‘জামানত জাপ্ত পার্টি’ (এমন একটি দল যা তাঁর সবকিছু হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে) বলে বিদ্রূপ করা হতো।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল অসংখ্যবার বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা তাঁর মৃত্যুসংবাদও লিখেছিলেন। দিল্লিতে ৪ শতাংশ ও পাঞ্জাবে চারটি আসন পাওয়ার পরও দলটিকে মৃত দল ঘোষণা করা হয়েছিল।
আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম। তবে জানতাম, দিল্লির নির্বাচন ঝুলে আছে এবং যেকোনো সময় এর ঘোষণা আসতে পারে। তাই আমাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করতাম, লড়াইয়ে হেরে গেলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি। কিন্তু প্রথমবারের মতো আমি অরবিন্দের মতো দৃঢ়চিত্তের লোককে ভেঙে পড়তে দেখি। তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়ছিলেন। এরপর একজন জেনারেলের মতো ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেন। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে সব দুঃখ-দুর্দশা মোকাবিলা করে কীভাবে জয়ী হওয়া যায়, তার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
এটা ছিল আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই। জয়ই ছিল একমাত্র পথ। আমরা নেতিবাচক দিকগুলো খুঁজে প্রধান তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করি। এগুলো হলো :
১. আমরা উপলব্ধি করি যে দিল্লিবাসী মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাঁরা প্রতারণার স্বীকার। তাঁরা কেজরিওয়ালকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর পদত্যাগ করা উচিত হয়নি। তাই তিনি সবার সামনে নিজের ভুল স্বীকার করেছিলেন এবং কথা দিয়েছিলেন, আর পদত্যাগ করবেন না।
২. এএপি ধরনা (কোনো দাবিতে অহিংস অবস্থান) নিয়েই পড়ে থাকে, এমন অভিযোগ ছিল। বুদ্ধিজীবী মহলে আমাদের কদর ছিল সামান্য। এ থেকে উত্তরণে আমরা একটি কাজের তালিকা তৈরি করি। দিল্লি সংলাপ ছিল এগুলোর একটি। এটা এ ধারণা দিতে পেরেছিল যে ইশতেহার তৈরি একদিনের ব্যাপার নয়। এর পর থেকে এএপি নিজেদের ভারসাম্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এএপিকে প্রমাণ করতে হয়েছিল, তাঁরা সরকার গঠনে সক্ষম। এরই ধারাবাহিকতায় দলে একটা নীতিনির্ধারণ করা হলো। দিল্লির উন্নয়নকে আলোচনায় আনা হলো। পরবর্তী সময়ে এটাকে প্রধান উপজীব্য ধরে প্রচারণা শুরু হলো।
৩. গত বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের স্বেচ্ছাসেবী ভিত অনেক শক্ত থাকলেও এর কোনো কাঠামো ছিল না। দল এটিকে আরও দৃঢ় করার সিদ্ধান্ত নিল। সেটিকে ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। এ লক্ষ্যে ১০টির বেশি সংস্থা গঠন করা হলো। যে সময়ে দিল্লি নির্বাচনের ঘোষণা এলো, সে সময় এএপি পরিকল্পনায় অনেকটাই এগিয়ে গেল। এরই মধ্যে কেজরিওয়াল প্রতিটি কেন্দ্রে দুবার করে সফরও সম্পন্ন করেন।
যখনই নেতিবাচক দিকের তালিকা তৈরি হলো, তখনই তা শোধরানোর চেষ্টা শুরু হলো। দলীয় কৌশলের অংশ হিসেবে কেজরিওয়ালের মতামত ছিল, তাঁর দল দিল্লির বাইরে বিধানসভা তো নয়ই, কোনো পৌরসভা নির্বাচনেও অংশ নেবে না। দলের কিছু নেতা তাঁর এই মতের বিরুদ্ধে গেলেও তিনি ছিলেন অবিচল। তিনি দিল্লি নির্বাচনে কোনো প্রতিকূলতা চাননি।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে আমরা মনোবল ফিরে পাই। আমরা জানতাম, এটা হবে কঠিন লড়াই। কিন্তু টিকে থাকতে হবেই। আমাদের একমাত্র প্রতিবন্ধক ছিলেন মোদি। আমরা রামলীলা ময়দানের র্যালিতে মোদির ভাষণের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় খুশিই হয়েছিলাম।
বিজেপি খুব হতাশ হয়ে পড়ে এবং অরবিন্দের মতো একজন বিশ্বস্ত লোক খুঁজতে থাকে। কিন্তু দলের ভেতর থেকে কাউকে না পেয়ে কিরণ বেদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে। আমরা কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু কিরণ বেদি যখন ক্যামেরার সামনে কথা বলা শুরু করলেন, তখন তিনিই হলেন এএপির সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তিনি বলতে লাগলেন। নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি। বিপরীতে আমাদের ঘোষণাপত্র তৈরিই ছিল।
বিজেপির আরো একটি ভুল ছিল। তারা নেতিবাচক বিষয় আর গালাগালেই পড়ে ছিল। বিপরীতে আমরা ছিলাম অতি সতর্ক। আমরা দুর্নীতি দূরীকরণ, বিদ্যুতের মূল্য অর্ধেক করা, বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করার ঘোষণা দিলাম। কিন্তু বিজেপি এমন ঘোষণা দেয়নি। বিনামূল্যে ওয়াইফাইও ছিল একটি ইস্যু। গরিব ও প্রান্তিক লোকজন আমাদের সঙ্গে ছিল। কংগ্রেস কোনো প্রতিযোগিতায় না থাকায় সংখ্যালঘুরাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অন্যদিকে, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও বিজেপির নেতিবাচক প্রচারণায় হতাশ হয়। অরবিন্দকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাতের কারণে তারা বিজেপি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। বড় বড় প্রতিজ্ঞা করে কোনো বাস্তবায়ন না করায় জনগণের মধ্যে মনমোহন সিং থেকে মোদি আলাদা বলে যে ধারণা ছিল, তা ভেঙে যায়। আমরা চেয়েছিলাম, এই নির্বাচনে কেজরিওয়াল বড় ব্যবধানে জিতুক। এটা সফলভাবে করতে পেরেছি।
ইতিহাসে এই নির্বাচন একটি ‘গেম চেঞ্জার’ (পটপরিবর্তনকারী) হিসেবে আখ্যায়িত হবে। আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি, সুষ্ঠু রাজনীতি সম্ভব। বিজেপির মতো এত অর্থ-সম্পদ এএপির না থাকলেও নৈতিক বল অনেক বেশি। ভারতের জনগণ অর্থশক্তি আর পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রিত গতানুগতিক ধারার রাজনীতি দেখতে দেখতে বিরক্ত। তাঁরা এর বিকল্প চায়।
এএপির বিরাট জয়ে একটা নতুন শক্তির আবির্ভাব হবে। একটা নতুন সূর্যের উদয় হবে। এটা রাজনীতিকে শীতল করবে। সাধারণ জনগণ এখন রাজনীতিতে আসতে পারবে; সফলও হতে পারবে। রাজনীতি আর কোনো নোংরা খেলা নয়। এএপির ছোট একটি পদক্ষেপে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।
সাবেক সাংবাদিক ও লেখক আশুতোষ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এএপিতে যোগ দেন। গত লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির চাঁদনি চক আসন থেকে কংগ্রেসদলীয় সাবেক মন্ত্রী কপিল সিবাল ও বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাঁর লেখা নিবন্ধটি আজ এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আজহারুল ইসলাম