একুশ শতকেও যারা আঠারোতে থেমে
জনাকীর্ণ নিউইয়র্ক থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ। পিচঢালা রাজপথ, চারদিকে শান্ত। সবকিছু যেন ছবির মতো। এ গ্রামের এমন শান্ত-নিঝুম পরিবেশ পুরোনো দিনের ইংরেজি সিনেমার কোনো দৃশ্যের কথাই মনে করিয়ে দেবে আপনাকে।
এ গ্রামের বাড়িঘর আর এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার ধরন দেখে আপনার মনে হবে যেন আপনি আঠারো শতকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু না, প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার একটি গ্রাম এটি। তিনশ বছরের পুরোনো ধ্যান-ধারণা আর জীবন-জীবিকা ধরে রাখা এ জনগোষ্ঠীকে স্থানীয়রা বলে ‘অ্যামিশ’। আর স্থানীয়ভাবে এ গ্রামকে ডাকা হয় অ্যামিশ ভিলেজ বলে।
প্রযুক্তির এ উৎকর্ষের যুগে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক লাখ মানুষের এ বিশেষ জনগোষ্ঠী প্রযুক্তির ধারেকাছেও নেই। ছবি তোলা তো নয়ই, বাইরের কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না তারা। এখানকার পিচঢালা পথে মাঝেমধ্যে মোটরগাড়ির দেখা মিললেও অধিবাসীদের বাহন একশ্রেণির ঘোড়ার গাড়ি।
মোটরগাড়ি নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করার পরই কয়েকজন ক্যামেরা দেখে বেশ উঁকি মারে। সাহস নিয়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে অনেক ডাকাডাকির পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়া মেলেনি তাদের।
এভাবেই নিজেদের আড়াল করে রাখা অ্যামিশরা ষোড়শ শতকের শেষ দিকে উচ্চ কর, মূল্যস্ফীতি ও যুদ্ধের গুজবে জ্যাকব আমিনের নেতৃত্বে ইউরোপ থেকে পাড়ি জমায় আমেরিকায়। বর্তমানে আমেরিকা ও কানাডার ২৮টি প্রদেশে প্রায় আড়াই লাখ অ্যামিশ বসবাস করছে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় বাস করে ৫০ হাজারের বেশি অ্যামিশ।
প্রযুক্তিবিমুখ এ সম্প্রদায় প্রধানত চাষাবাদ করে। কিন্তু তাতেও রয়েছে নিজস্ব ও আলাদা ঢং। অ্যামিশরা তাদের বেশির ভাগ খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করে। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত কিছু নেই। তবে পেঁপে, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ফলায় তারা। চাষের জন্য কোনো ট্রাক্টর নেই তাদের। জমি চাষ করতে তারা বিশেষ ধরনের ইঞ্জিনচালিত ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, অ্যামিশরা প্রধানত কৃষিকাজ ও নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করে। তাদের নিজস্ব কিছু ব্যবসাও আছে। কিছু কিছু অ্যামিশ অনেক ধনী, আবার কেউ কেউ খুবই গরিব।
খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী অ্যামিশরা খাদ্যের মতো পোশাকও নিজেরাই তৈরি করে। এক রুমের বিশেষ ধরনের স্কুলে অ্যামিশ শিশুরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পায়। আর তাদের পড়ান অবিবাহিত তরুণীরা। সামাজিক বাধ্যবাধকতায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই তাদের।
বাড়িতে নিজেদের কাজ ভাগাভাগি করে নিতে হয় সবাইকে। আর অ্যামিশরা এতটাই প্রযুক্তিবিমুখ যে বর্তমানে আমরা যা ছাড়া নিজেদের কল্পনাই করতে পারি না, প্রযুক্তির ন্যূনতম সে সুযোগও গ্রহণ করে না তারা। তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস সংযোগ নেই। অ্যামিশরা টেলিভিশনও দেখে না, গানও শোনে না।
সবকিছু মিলিয়ে একেবারেই সাদামাটা জীবনযাপন করা অ্যামিশদের অন্য সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরতা নেই বললেই চলে। তাই একবিংশ শতাব্দীতেও তাদের জীবনযাপন সত্যিই অবাক করার মতো।