তুরস্ক কেন কাতারের পাশে?
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/06/14/photo-1497460273.jpg)
সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) সদস্য তিন দেশসহ মিত্রদের কূটনৈতিক অবরোধে কাতার যখন এক রকম বিচ্ছিন্ন, ঠিক সেই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে অনারব সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলিমদের দেশ তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ কর্তাব্যক্তিরা কাতারের সমর্থনে দিয়েছেন বক্তব্য। এমনকি তুরস্ক থেকে বিমানে করে কাতারের রাজধানী দোহায় পাঠানো হয়েছে দুধ, দই, মুরগির মাংস ও জুস।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া উল্লিখিত বিষয়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। সেটি হলো, জিসিসির সদস্যভুক্ত আয়তনে ছোট দেশ কাতারকে এমন প্রকাশ্য সমর্থন কেন দিচ্ছে ভৌগোলিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়ায় থাকা প্রভাবশালী রাষ্ট্র তুরস্ক? অনেকটা ফ্রিকোয়েন্টলি আসকড কোয়েশ্চেন (এফএকিউ) বা প্রতিনিয়ত করা সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে তুরস্কের প্রতি কাতারি জনগণের অনুভূতি উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তুরস্কের একটি ব্র্যান্ডের দুধের বোতলে ভরা সুপার মার্কেটের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে পোস্ট করেন কাতারের এক নাগরিক। সেই পোস্টে তিনি লিখেন, ‘দুধ পাঠানোয় তুরস্ককে ধন্যবাদ।’
গতকাল মঙ্গলবার কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টিকে ‘নিষ্ঠুর’ বলে আখ্যা দেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি আরো বলেন, আবর দেশগুলোর নেতৃত্বে প্রতিবেশী দেশের প্রতি এই অবরোধ ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী ও মৃত্যুদণ্ডের শামিল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের পরের দিন আজ বুধবার কাতারে যাওয়ার সূচি ছিল তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাতারের সঙ্গে যখন সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে, সেই সময়ে তুরস্কের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, কোনো পক্ষ না নেওয়া এবং সংলাপের আহ্বান জানানো। কিন্তু এর মাত্র দুই দিন পর আঙ্কারা নাটকীয়ভাবে কাতারের পক্ষে অবস্থান নেয়।
কাতারে সেনা মোতায়েনে তুরস্কের পার্লামেন্টে একটি বিলে অনুমোদন দেওয়ার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হলো যে, দোহা একা নয়। অথচ কাতার সংকট শুরু হওয়ার দুই বছর আগে থেকে পার্লামেন্টে অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল বিলটি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাতারের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক বেড়েছে। ২০১৫ সালে সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। এ ছাড়া কাতারে সামরিক ঘাঁটি করেছে তুরস্ক যাতে ১০০ তুর্কি সেনা মোতায়েন আছে। এতে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সেনা রাখা যাবে।
সামরিক ঘাঁটিতে ভবিষ্যত মোতায়েনের বিষয়টি সমন্বয় করতে সোমবার তিন কর্মকর্তাকে কাতারে পাঠিয়েছে তুরস্ক। কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুরুতে পদাতিক সেনা, পরে নৌবাহিনীর সদস্য ও এফ ১৬ জঙ্গি বিমান মোতায়েন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সদস্য হতে দর কষাকষি করতে থাকা দেশটি।
আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর দোহাকে অন্যতম মিত্র হিসেবে পাওয়া যায় বলে মনে করে আঙ্কারা। গত বছর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সেনাদের একাংশের অভ্যুত্থানের চেষ্টাকালে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি।
অভ্যুত্থানচেষ্টার পর এরদোয়ানের কড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাতারি বিশেষ বাহিনীর ১৫০ সদস্যের একটি ইউনিট তুরস্ক পাঠানো হয়েছিল বলেও খবর পাওয়া যায়।
দুই দেশের সরকারের মধ্যে মতাদর্শিক ঐক্যও রয়েছে। মিসরে সক্রিয় মুসলিম ব্রাদারহুড ও ফিলিস্তিনের গাজার শাসক দল হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ না বলে দুটি দেশই ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির উৎখাতের নিন্দা জানায়। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের শাসনক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিয়েছে দুটি দেশই।
ইরানের প্রতিও দেশ দুটির একই দৃষ্টিভঙ্গি। দুই পক্ষই স্বীকার করে নিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তি ইরান। সৌদির মতো ইরানের প্রতি অব্যাহত বিষোদগারের রাজনীতি থেকে সরে উভয়পক্ষই সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
কাতারে বিপুল বিনিয়োগও করেছে তুরস্ক। দোহায় বিদেশি বিনিয়োগকারী পক্ষগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান সপ্তম।
২০১৫ সালে কাতারে ৪২ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি করে তুরস্ক। একই বছরে তুরস্কে ৩৬ কোটি এক লাখ ডলারের বেশি রপ্তানি কাতার।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে কাতারে ১২৬ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে তুরস্ক। একই বছর থেকে কাতার থেকে তুরস্কে রপ্তানি কমেছে ২৫ শতাংশ।
তুরস্কের নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু অস্ত্র চুক্তি করার কথা ভাবছে কাতার। ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠেয় ফুটবল বিশ্বকাপের আগে দেশটিতে বিনিয়োগের চিন্তা করছে তুরস্কের ব্যবসায়ীরা।
উল্লিখিত হিসাবগুলো থেকে কাতারের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া গেছে। তবে কাতারের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সংঘাত সামরিক পর্যায়ে পৌঁছালে তুরস্ক কী অবস্থান নেবে? সময়ই এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর।