ভারতে ‘জীবিত-মৃত’ মানুষের পুনরুত্থানের যুদ্ধ
ভারতের উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা রামজনম মাউরিয়া গত দুই বছরে বহুবার আজমগড় জেলা শহরের ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে গেছেন। প্রতিবার তাঁর সঙ্গে থাকে একগাদা কাগজপত্র। এর মাধ্যমে রামজনম প্রমাণ করতে চান তিনি ভূত নন, জীবিত।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে রামজনম মাউরিয়া বলেন, ‘এটি হতাশাজনক। আমি জীবিত, অথচ তারা (প্রশাসন) বলছে, আমি বেঁচে নেই!’
৬৫ বছর বয়স্ক রামজনমের মতো উত্তর প্রদেশের শত শত মানুষ জীবিত থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের নথিপত্রে মৃত। সম্পত্তি ও জমিজমা দখল করতে ওই ব্যক্তিদের বিবেকবর্জিত আত্মীয়রা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
রামজনম মাউরিয়ার অভিযোগ করেন, উত্তরাধিকার সূত্রের সম্পত্তির বড় অংশ পেতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে তাঁকে কাগজপত্রে মৃত দেখিয়েছেন তাঁরই ভাই।
উত্তর প্রদেশের কাগজপত্রে মৃত দেখানো অনেকেই নিজেদের ভাই, ভাতিজা এমনকি নিজের ছেলের লোভের শিকার। তাঁরা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে মিথ্যা নথিপত্র তৈরি অথবা নথিপত্র ধ্বংস করিয়েছেন।
কাগজপত্রে কোনো ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর অধিকাংশ ঘটনাই দেখা যায় ভারতের উত্তরে প্রদেশে। অন্যতম জনবহুল এই রাজ্যে দুর্নীতি ও অপরাধের হারও বেশি।
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের আজমনগর জেলায় কয়েক দশক ধরেই জীবিত ব্যক্তিকে নথিপত্রে মৃত দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। জমি নিয়ে নিয়ে বিরোধ বেড়ে যাওয়ায় এমন অভিযোগও বেড়েছে।
মৃতক সংঘ
আজমগড় জেলার অপর বাসিন্দা লাল বিহারি ৪০ বছর আগে জানতে পারেন তাঁর তিন বিঘা জমি নিজের নামে করে নিয়েছেন তাঁরই এক ভাই। ওই ভাই স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে লাল বিহারিকে নথিপত্রে মৃত দেখান।
আদালতে নিজেকে জালিয়াতির শিকার ও জীবিত প্রমাণ করেন লাল বিহারি। এরপর তিনি ‘মৃতক সংঘ’ নামে নথিপত্রে মৃতদের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর সংগঠন তাঁর মতো সমস্যায় পড়া ব্যক্তিদের জীবিত প্রমাণে সহায়তা করে।
লাল বিহারি বলেন, মাসের পর মাস বিভিন্ন কার্যালয়ে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর অবস্থা হয়েছিল পাগলের মতো। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থা হয় মাঝেমধ্যে মনে হয় নিজের অস্তিত্বই নেই। কোনো শত্রু হাত নোংরা করে একজনকে হত্যা না করেই মৃত বানিয়ে ফেলে।’
ভারতের সাধারণ নির্বাচনে দুজন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়া লাল বিহারি বলেন, তাঁর সংগঠন দেশজুড়ে নথিপত্র মৃত ২০০টি অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়ছে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, নথিপত্রে মৃত প্রমাণ করে জালিয়াতির সব সমস্যাই সমাধান করা হয়েছে। এখনো কিছু মানুষ ভুয়া অভিযোগ করছে।
আজমগড় জেলা ম্যাজিস্টেট এল ওয়াই সুহাস বলেন, বতর্মানে সব ধরনের তথ্যই কম্পিউটারে নেওয়া হয়েছে, যেখানে ব্যক্তিগত বিবরণও সংরক্ষণ করা আছে। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ শুধু শুধুই প্রচার চায়।’
অজানা থাকে দীর্ঘদিন
অনেক ক্ষেত্রেই নথিপত্রে মৃত বানানোর দীর্ঘদিন পর বিষয়টি জানা যায়। যেমনটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের রামজনম মাউরিয়ার ক্ষেত্রে। কিছু জমি ছেলেদের নামে দলিল করে দিতে গিয়ে মাউরিয়া জানতে পারেন সরকারি নথিপত্রে তিনি মৃত।
১৯৯৩ সালে নিজের বাবার কাছ থেকে দেড় হাজার বর্গমিটার জমি পান রামজনম মাউরিয়া। কয়েক বছর পর তিনি ওই জমি দেখভালের দায়িত্ব ভাইয়ের কাছে দিয়ে শ্বশুরের গ্রামে চলে যান। ২০১৩ সালে ছেলের নামে জমি দলিল করে দিতে গিয়ে রামজনম জানতে পারেন সরকারি নথিপত্রে তিনি মৃত আর জমির একমাত্র মালিক তাঁর ভাই। রামজনম মাউরিয়া বলেন, ‘ভাইয়ের কর্মকাণ্ড জানতে পেরে আমি খুব কষ্ট পাই।’
যাঁর জন্মই হয়নি
উত্তরপ্রদেশের মিষ্টি বিক্রেতা জগদীশ প্রসাদ গুপ্তকে (৫২) নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘সরকারি নথিতে বলা হচ্ছে আমার জন্মই হয়নি। শিশু বয়সে আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে।’
১৯৯৭ সালে উত্তরপ্রদেশের একটি রাজস্ব কার্যালয় জানায়, জগদীশ প্রসাদ গুপ্তের কোনো অস্তিত্ব নেই। জগদীশের সন্দেহ এক নারী আত্মীয় কর্মকর্তাদের দিয়েছে। ২০০২ সালে আবার বিষয়টি উত্থাপন করা হলে আবারও তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়।
গুপ্ত বলেন, তিনি জমির ব্যাপারে আগ্রহী নন। নিজের সন্তানরা যেন আমলাতান্ত্রিক কোনো জটিলতায় না পড়েন এই বিষয়টিই নিশ্চিত করতে চান গুপ্ত।
জমিই যেখানে সব
উত্তরপ্রদেশের ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর শিক্ষক মোহাম্মদ আরশাদের মতে, জমির অধিকার নিয়ে সমস্যা থেকেই মানুষকে নথিপত্রে মৃত দেখানোর অভিযোগ দেখা যায়। তিনি বলেন, ভারতে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে। একই সঙ্গে জনসংখ্যাও বাড়ছে, যা বতর্মানে ১২৫ কোটির মতো। কিছু মানুষ জমির দখল নিতে আপন রক্ত-মাংসের সঙ্গেই প্রতারণা করছে।
আরশাদ বলেন, ‘জমি থাকলে একজন ব্যবসায়িক অংশীদারকে আকৃষ্ট করতে পারে। এ ছাড়া নিজ ও সন্তানদের বিয়ের ক্ষেত্রেও আকৃষ্ট করা যায়। জমিই এখানে পার্থক্য গড়ে দেয়।’