রথে দাঁড়িয়ে বাবা বললেন, আমিই সর্বশক্তিমান
এবার মুসলমানদের ঈদের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা। রথযাত্রার প্রবাদ আছে, ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী’। তবে এবার কলকাতার রথযাত্রায় রথ, পথ, দেব সবাইকে টেক্কা দিয়ে রথের ওপর স্বয়ং চেপে বসেছেন এক স্বঘোষিত ধর্মগুরু সিংরাই বাবা।
গেরুয়া ধুতি, মাথায় লাল ফেট্টি আর অনাবৃত শরীরে রুদ্রাক্ষের মালা পরে নীল-হলুদ রঙের পাঁচতলা রথের ওপর চেপে বসেছেন সিংরাই বাবা। কলকাতায় রথযাত্রার সকালে এ দৃশ্য দেখতে হাজারো মানুষ পথের ধারে জমা হয়।
শনিবার সাতসকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কুলটির রাজপথে দেখা যায় এই ব্যতিক্রমী দৃশ্য। সিংরাই বাবাকে রথের ওপর বসিয়ে কুলটির জিটি রোড ধরে নিয়ামতপুরের রাস্তায় টেনে নিয়ে যায় একদল আদিবাসী।
রাস্তার দুই পাশ থেকে উৎসাহী জনতা তখন সিংরাই বাবার উদ্দেশে গলা ফাটাচ্ছে, ভগবান সুভদ্রা-জগন্নাথ-বলরামের জায়গায় আপনি রথের ওপর চেপে বসেছেন কেন? আপনি কি দেবতা? উত্তরে এক্কেবারে আশীর্বাদের ঢঙ্গে হাত তুলে সিংরাই বাবা জানালন, ‘যুগে যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে হজরত মুহাম্মদ সাধনার মাধ্যমে যদি পরবর্তীতে ঈশ্বর ও আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমিওবা আদিবাসীদের দেবতা হব না কেন?’ এই উত্তরে জনতাকে চুপ করিয়ে দিয়ে মৃদু হাসতে হাসতে রথে বসে চললেন সিংরাই বাবা।
সিংরাই বাবা নিজের মূর্তি গড়ে নিজের পূজো করে আসছেন ৩৭ বছর ধরে। আদিবাসী সমাজের একের পর এক ধর্মীয় নিয়মনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে এর আগে বহুবার তিনি সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এবার এক্কেবারে রথের ওপর চেপে বসে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছেন তিনি।
কে এই সিংরাই বাবা? তাঁর আসল নাম সিংরাই মারান্ডি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্য (পূর্বেকার বিহার)-এর দুমকা এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল শিল্পাঞ্চলে রুটি রুজির টানে চলে আসেন।
ইন্টারমিডিয়েড পাস করা সিংরাই আসানসোলে এসে চাকরিও পেয়ে যান ভারতীয় রেলে। শিল্পাঞ্চলে থাকতে থাকতেই ধীরে ধীরে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-অর্চনার দিকে আগ্রহী হতে থাকেন তিনি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেবতা মারাং বুরুর পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা দেব-দেবীকে আদিবাসী সম্প্রদায়ে জনপ্রিয় করে তোলার কাজ শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের নতুন ধর্মগুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার কাজে মন দেন মারান্ডি। হঠাৎ একদিন সকালে নিজেকে স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত ধর্মগুরু বলে ঘোষণা দেন তিনি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, স্বপ্নে তিনি আদেশ পেয়েছেন তিনিই সর্বশক্তিমান। ব্যস, তারপরেই বানিয়ে ফেললেন পেল্লাই সাইজের একখানা ‘সিঙ্গাবোঙ্গা’ মন্দির। আর সেই মন্দিরের ভেতর প্রতিষ্ঠা হলো সিংরাই বাবার বিশাল পাথরের মূর্তি। সিংরাই মারান্ডি রাতারাতি হয়ে গেলেন সিংরাই বাবা। যাঁর শিষ্যত্ব শুধু স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষই নন, ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ শিবু সোরেনও।
রথযাত্রার পুণ্যলগ্নে আজ শনিবার সকাল ৮টা নাগাদ সিংরাই বাবা রথ বের করে সেই রথের ওপরেই চেপে বসেন। আর সেই রথ টানতে টানতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরেন। আদিবাসী মানুষরা বললেন, নানা রাস্তা ঘুরে উল্টোরথে আবার আশ্রমে ফিরে আসবে। রথের দিন সিংরাই বাবা শুধু রথযাত্রাই করেননি, নতুন বিধানও চালু করেছেন। আদিবাসী মহিলাদের নির্দেশ দিয়েছেন, রথের দড়িতে টান দেওয়ার আগে স্বামীদের পূজা করতে হবে। যদিও এই বিষয়ে গুরুজি এদিন রথে বসেই বললেন, নারীনাং ভূষনাং পতি। হিন্দু ধর্মে অহল্যা, সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তীর মতো নারীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন নারীর ভূষণ হলো পতি।
সিংরাই বাবার এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে মানুষের ঢল উপচে পড়ে আসানসোলের রাস্তায়। অনেকে অবশ্য এটাকে সিংরাই বাবার বুজরুকী বলে কটাক্ষও করেছেন। রথের ওপর দাঁড়িয়ে হাজারে হাজারে উপস্থিত জনতার দিকে হাত উঁচু করে আশীর্বাদ করতে করতে হাসিমুখেই সিংরাই বাবা বললেন, ‘অনার্য (আদিবাসী) সমাজের আমিই একমাত্র পরিবর্তনের রূপকার।’