আমরা এক ভয়াবহ বিশ্ব গড়ে তুলছি : নোয়াম চমস্কি

প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশ্বকে একটি ভয়াবহ স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষণবিষয়ক সাময়িকী ‘জ্যাকোবিয়ানে’র কাছে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। ‘জ্যাকোবিয়ান’-এর সাংবাদিক ডেভিড বারসামিয়ানের সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসআইএসের উত্থান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা বিষয়ে চমস্কি নিজের চিন্তা তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটির কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
ইরাকে জাতিগত সংঘাত থেকেই আইএসআইএলের উত্থান দাবি করে নোয়াম চমস্কি বলেন, সম্প্রতি তিনি গ্রাহাম ফুলার নামে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এক সাবেক কমকর্তার একটি সাক্ষাৎকার পড়েছেন। গ্রাহাম ফুলার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত। ‘যুক্তরাষ্ট্র আইএসআইএস তৈরি করেছে’ এই শিরোনামের ওই সাক্ষাৎকারে সাবেক কর্মকর্তা এক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেন। আইএসআইএসের উত্থান নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাজারো তত্ত্ব ছড়িয়ে থাকলেও এটি ভিন্ন। কারণ এই তত্ত্বটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র আইএসআইএস সৃষ্টি করেছে ও অর্থায়ন করেছে এমন কথা বলেননি গ্রাহাম। বরং আইএসআইএস তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সাক্ষাৎকারে নোয়াম চমস্কি ফুলারের তত্ত্বের বরাত দিয়ে বলেন, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন চালায়। অনেক ইরাকি একে হাজার বছর পূর্বের মঙ্গলদের ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের সঙ্গে তুলনা করেন। ইরাক যুদ্ধে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছেন আরো কয়েক লাখ। বসতবাড়ি হারিয়ে অনেকে হয়েছেন ঠিকানাবিহীন। ইরাকে ছিল সুমেরু সভ্যতার অনেক নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন। যুদ্ধের কারণেই প্রায় সবই ধ্বংস হয়েছে বা চুরি গেছে।
আগ্রাসনের কিছু পরেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান পল ব্রেমার নতুন উদ্যোগ নেন। তারা ইরাকের সুন্নি, শিয়া ও কুর্দি জনগোষ্ঠীকে আলাদা করেন এবং এক গোষ্ঠীকে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ইরাকের সুন্নি, শিয়া ও কুর্দি জাতিগত সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে।
নোয়াম চমস্কি বলেন, বাগদাদের মানচিত্রেই জাতিগত সংঘাতের ভয়াবহতা চোখে পড়ে। ২০০২ সালে বাগদাদ ছিল এক মিশ্র জাতি গোষ্ঠীর শহর। একই এলাকায়ই সুন্নি ও শিয়া দেখা যেত। তাঁদের মধ্যে বিয়েও হতো। অনেকেই জানতেনই না কে সুন্নি আর কে শিয়া। মতেভিন্নতা ছিল কিন্তু ভয়াবহ শত্রুতা ছিল না। দীর্ঘ একটি সময় বাগদাদের এমন অবস্থা দেখা গেছে। বাগদাদবাসী বলত, তারা কোনোদিনই সুন্নি-শিয়া সংঘাতে যাবে না। জীবন ভালোই চলছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো চিত্র পাল্টে গেল। শুধু বাগদাদে নয়, ইরাকজুড়েই সুন্নি-জিয়া সংঘাত ছড়িয়ে পড়ল। বর্তমানে শুধু ইরাক নয়, সিরিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে এই সংঘাত। পুরো এলাকা ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
নোয়াম চমস্কির মতে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসআইএসের বর্তমান সংঘাতের চিত্রটা এমন, সব সময়ই সবচেয়ে খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। আইএসআইএসের মূল অন্য কোথাও। এই মূলটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রায় পুরোটাই জুড়ে আছে সৌদি আরব। আর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কারণ বিপুল পরিমাণ তেলের মজুদ।
সম্প্রতি প্রভাবশালী সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের উদ্যোগ সত্ত্বেও ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা প্রস্তাব কংগ্রেসে অনুমোদন না হওয়া প্রসঙ্গে নোয়াম চমস্কি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে এলিজাবেথ ওয়ারেনের কোনো ধারণাই নেই। তাঁর (চমস্কি) মতে এই পদক্ষেপ ছিল অবধারিত। ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সরাসরি তাঁদের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি অন্যরকম।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার অন্যতম অংশীদার মনে করে। উইকিলিকসের ফাঁস করা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন নথি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজুড়েই অনেক স্থানে দেশটির গোপন সামরিক স্থাপনা বা গবেষণা ঘাঁটি আছে। ধারণা করা হয়, ইসরাইলের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গবেষণা ঘাঁটি আছে। ইসরাইলের রাফায়েল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ নামক স্থাপনায় ড্রোনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে। এই স্থাপনার ব্যবস্থাপনার সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে এমন দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানও ইসরাইল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট হাজার কোটি ডলারে ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান কেনার কথা জানিয়েছেন। এর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে। এ ছাড়া প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলসহ যুক্তরাষ্ট্রের নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান ইসরাইলে বিনিয়োগ করছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ইসরাইল বিনিয়োগের জন্য আদর্শ। একই সঙ্গে অঞ্চলটি সংঘাতময়। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নিয়মনীতি এখানে খাটে না।
‘জ্যাকোবিয়ান’ সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নোয়াম চমস্কি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর মত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি ভয়াবহ পৃথিবী তৈরি করছি। গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর হাজারো মানুষ নিউইয়র্ক শহরে জড়ো হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি ছিল তাঁদের।
চমস্কি বলেন, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে কথা বলা কোনো মজার বিষয় নয়। এই প্রথম মানব প্রজাতি হিসেবে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে, পরবর্তী প্রজন্মের বাঁচার মতো কোনো বিশ্ব আমরা রেখে যাব কি না। পৃথিবীতে এর আগে কখনোই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতটা ভয়াবহ দেখা যায়নি। এরই মধ্যে মানুষের সিদ্ধান্তের কারণে পৃথিবীর অনেক প্রাণী প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
নোয়াম চমস্কি বলেন, বর্তমানে প্রাণী প্রজাতি ধ্বংসের হার ছয় কোটি ৫০ লাখ বছর আগের পৃথিবীর মতো। ওই সময় একটি গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর জলবায়ুতে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল। এতে ধ্বংস হয় ডাইনোসর প্রজাতি। এর ফলে ছোট প্রাণীর বংশবিস্তারের সুযোগ ঘটে। যার ধারাবাহিকতায় মানুষ এসেছে পৃথিবীতে। একই প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে। পূর্বের অবস্থার সঙ্গে বর্তমান সময়ের পার্থক্য শুধুই- গ্রহাণু আঘাত না করা। পৃথিবীর জলবায়ুর যে ক্ষতি মানুষ করেছে তা ছয় কোটি ৫০ লাখ বছর আগের গ্রহাণুর আঘাতের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মানুষের সভ্যতা বিলুপ্তির মুখে।