মংডুতে অর্থনৈতিক অঞ্চল, চুক্তি করছে রাজ্য সরকার
রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত ও সহিংসতাপ্রবণ মংডু জেলায় নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ জোরেশোরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। চলতি সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দের জন্য স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে রাখাইন রাজ্য সরকার।
রাখাইন রাজ্য সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ইউ কে আই থিন সম্প্রতি গণমাধ্যম ফ্রন্টিয়ারকে বলেন, ‘নাফ রিভার গ্যালাক্সি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ’ নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে মংডু অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে একটি স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর এ চুক্তি হবে।
অর্থনৈতিক জোনের জন্য নির্ধারিত এলাকায় নাফ নদীর তীরবর্তী রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম কানইয়েন চংয়ে সরকার ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
কানইয়েন চং গ্রামটি চোরাচালানের পথ ও ভয়ানক অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে এতটাই কুখ্যাত যে এখানে দিনের বেলায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রবেশ করতে ও টহল দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। ২৫ আগস্ট নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্রায় দুই ডজন পুলিশ ও সেনাক্যাম্পে হামলার পর বিদ্রোহীদের ধরার নাম করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘জাতিগত নিধনের’ জন্য যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তাতে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গার প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মংডুসহ রাখাইনের বিভিন্ন এলাকা থেকে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম নদী ও সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্যমতে, রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের জন্য এখন পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৬৮টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে রাখাইন রাজ্য সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ইউ কে আই থিন বলেছেন, ‘যেদিন চুক্তি স্বাক্ষর হবে, সেদিন ওই এলাকার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’
মন্ত্রী আরো বলেন, আগের রাজ্য সরকার এখানে একটি বাণিজ্য-অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এই সরকার শুধু সেটিকে আরেক ধাপ অগ্রসর করে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। আর এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার নয়, বরং রাখাইন রাজ্য সরকারের হাতেই থাকবে।
এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমূল্যে জমি পাবেন এবং এর জন্য তাদের কোনো করও দিতে হবে না বলেও জানান রাখাইন রাজ্যের এই মন্ত্রী।
‘নাফ রিভার গ্যালাক্সি’র পেছনে কারা?
‘নাফ রিভার গ্যালাক্সি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ’-এর পেছনে কারা রয়েছে, এর একটি হদিস দিয়েছে গণমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার। গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে নতুন করে সেনাবাহিনী হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণের শুরু করে। বিনিয়োগ ও কোম্পানি প্রশাসন অধিদপ্তর জানাচ্ছে, এর ১০ দিনের মাথায়, অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বর ‘নাফ রিভার গ্যালাক্সি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ’ নিবন্ধিত হয়।
রাজ্য সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ইউ কে আই থিন জানান, এটি মংডু এবং ইয়াঙ্গুনের সাতটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ। কিন্তু তিনি সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম জানাতে চাননি।
রাখাইন রাজ্য সরকার এ নিয়ে মংডুর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে এবং তাদের এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে জন্য একটি যৌথ উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করা হয়। পরে ইয়াঙ্গুনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয় বলে জানান ইউ কে আই থিন।
যদিও এই কোম্পানির মাত্র দুজন পরিচালকের নামই জানা গেছে। তাদের মধ্যে একজনের মংডুতে এবং অন্য আরেকজনের ইয়াঙ্গুনে কাজ করার মতো নাগরিক নিরাপত্তা কার্ড রয়েছে।
মিয়ানমার সরকারের দাবি, গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী দুই ডজনের বেশি সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালায়। এর পরই হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণের শিকার চার লাখ নয় হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে।
পালিয়ে আসা বস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছেন, বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পুরুষদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে আর মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
মুসলিম রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরাই বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে—মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, এরই মধ্যে এই সহিংসতার শিকার হয়ে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন।
অপরদিকে বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশটির প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জ হাতয় জানিয়েছেন, রাখাইনের তিনটি শহরতলিতে মোট ৪৭১টি গ্রাম রয়েছে। এর মধ্যে ১৭৬টি গ্রামে কোনো মানুষ নেই। আশপাশের ৩৪টি গ্রাম থেকেও লোকজন পালিয়ে চলে যাচ্ছে। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।