নিজের ফেসবুক পেজে সমালোচনায় জর্জরিত সু চি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো সেনাবাহিনীর হামলা ও গণহত্যার বিষয়ে বরাবরই সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন দেশটির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রধান, শান্তিতে নোবেল জয়ী নেতা অং সান সু চি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বর্বরতার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার পরও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বিশ্বের মানুষ যেমন অবাক হচ্ছিলেন তেমনি তাঁর ওপর ক্ষোভও জমছিল। এবার সেই ক্ষোভ উগরে দেওয়ার যেন জায়গা পাওয়া গেল।
আর সেই জায়গাটি হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অং সান সু চির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ। যদিও পেজটিতে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের পর আর কোনো পোস্ট দেওয়া হয়নি।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল পেজের কভার ফটো আপলোড দেওয়া হয়। সেখানে সু চিকে সংসদে শপথ নিতে দেখা যায়। সেই ছবির নিচে এতদিন বহু কমেন্ট পড়লেও গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে কমেন্ট পড়তে শুরু করে। যার প্রায় সবই রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন নিয়ে।
এসব কমেন্ট যাঁরা করেছেন তাঁদের বেশিরভাগই মুসলমান হলেও বিশ্বের অন্য দেশের নাগরিকের সংখ্যাও কম নয়।
জোহেব মীর নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কারটি ধরতে আপনার লজ্জা হওয়া উচিত। দয়া করে এটি ফেরত দিন। আপনি এটা আর এটার যোগ্য নন।’
খান মোহাম্মদ স্টানিকজাই লিখেছেন, ‘মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যার বিষয়ে আপনার নীতি দেশে লজ্জা হচ্ছে। মুসলিম হত্যা বন্ধ করুন এবং নোবেলসহ শান্তি স্থাপনে পাওয়া সব পুরস্কার ফিরিয়ে দিন।’
সামিউল্লাহ শেহজাদ নামে এক ব্যক্তি সু চিকে শয়তানের মা বলেও সম্বোধন করেন।
এত দিন অং সান সু চিকে অনেক বিশ্বাস করলেও রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর চালানো গণহত্যা দেখার পর তাঁর ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে বলে জানালেন ডেভিড ডক মিলার। তিনি বলেন, ‘এসব থেকে আপনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন দাবি করতে পারেন না। একটি পক্ষ নিন। আপনার সাহসিকতা এই বিষয়ে এসে কাপুরুষতায় রূপ নিয়েছে।’
অং সান সু চি বিশ্বের হাজারো মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলছেন বলে মনে করছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী সোহেল রহমান। নিজের কমেন্টে তিনি লেখেন, সু চির চেহারা নারী হিটলারের মতো হয়ে গেছে।
বৌদ্ধধর্মে জীবহত্যা মহাপাপ বলে বিশ্বাস করা হয় উল্লেখ করে মিনহাজ কাজী প্রশ্ন করেছেন, তারপরেও কীভাবে দেশটিতে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে?
নোবেল শান্তি পুরস্কার নেওয়ার পর অসলোতে সু চি’র দেওয়া ভাষণের কথা মনে করিয়ে দেন মাইক ডোভারস্কগ। মাইক বলেন, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চালানো গণহত্যা এবং তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করা নিয়ে সু চি কে প্রশ্ন করতে চান তিনি।
জশুয়া অ্যালেন মুর নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী ও শিশুদের দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার পর থেকেই আপনি আমার সম্মান হারিয়েছেন। আপনি তাদের সাহায্যের জন্য কিছুই করেননি। রোহিঙ্গাদের সহযোগীতা না করার জন্য আপনাকে এবং মিয়ানমার সরকারকে ধিক জানাই।’
খন্দকার হিরোও অনেকের মতো অং সান সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার ফেরত নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে কোনো মানবতা নেই।
এসব কমেন্টে আন্তর্জাতিক আদালতে সুচির বিচারের দাবিও জানানো হচ্ছে। করা হচ্ছে গালাগালও।
জুয়েল ইব্রাহীম নামে এক ব্যক্তি সুচিকে অমানুষ বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সব মানুষকেই তিনি একাধারে অসহিষ্ণু ও নির্মম বলে উল্লেখ করেন।
সুচিকে শীতল হৃদয়ের শয়তান বলে উল্লেখ করেছেন জেইনাব জামাক। ভবিষ্যতে নেতৃত্ব হারাতে হবে এই ভয়েই সুচি রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে মুখ খুলছেন না বলেও মনে করেন এই নেটিজেন। তবে তিনি এটাও মনে করেন, যে নেতৃত্বের লোভে সুচি এসব করছেন তা হয়তো জীবদ্দশায় আর পাওয়া হবে না তাঁর।
ইয়াহইয়া তাকামুল নামে একজন লিখেছেন, ‘হাজারো মানুষের হত্যাকারী এই নারী অ্যাডলভ হিটলারের নারী চরিত্র। তিনি একজন ভ্যাম্পায়ার যিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ত পান করছেন। তাঁর সর্ব নিকৃষ্ট শাস্তি হওয়া উচিত।’
যখন অং সান সু চিকে মিয়ানমার সরকার সাজা দিয়েছিল তখন একজন মুসলিম হওয়ার পরেও সুচির পক্ষে ছিলেন বলে জানান আহমাদ শাহনেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘কারণ সে সশয় মনে হয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিন্তু আজ আমি আমার সেই কথা ফেরতদ নিচ্ছি। আপনি এখন আর কোনো মানবাধিকার কর্মী নন। এখন আপনি শয়তানের চেয়েও খারাপ।’
১৭৯৯ সাল থেকে যেই জাতিগোষ্ঠীটি মিয়ানমারের নাগরিক তাদের ওপর এই হত্যাযজ্ঞ দেখে কষ্ট পাচ্ছেন রোজালিন্ড রবিনসন। তিনি বলেন, যে সব কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সেগুলোর সঙ্গেই সু চি প্রতারণা করছেন।
অং সান সু চিকে বর্ণবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন নিলাদ্র রহমান। তিনি লেখেন, ‘আপনি নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্য নন। হয় এটা ফিরিয়ে দিন নয়তো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিন। তাঁদের চাহিদা পূরণ করুন, তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দিন।’
এদিকে ওই পোস্টে কমেন্ট করেছেন হ্লাইং ইউ নাইং নামে এক মিয়ানমারের অধিবাসী। তিনি অন্য কমেন্টকারীদের উদ্দেশে বলেন, এসব লিখে লাভ হচ্ছে না। কারণ, সম্ভবত এই পেজ সু চি চালান না। ফলে এসব কমেন্ট তাঁর সজরে পড়বে না। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তিনি আরো বলেন, ওখানে যা হচ্ছে তার সবটা জানা যাচ্ছে না। সেখানে শুধু মুসলিমরাই নয়, হিন্দুরাও কষ্ট ভোগ করছে। আর এসবের জন্য বহু পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনাকে দায়ী করেন তিনি। বলেন, সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সতর্কভাবে কাজ করছে। এক পক্ষীয়ভাবে এই ঘটনার বিচার না করতেও অনুরোধ করেন তিনি।
সবমিলিয়ে এই পোস্টের নিচে প্রায় ১৮ হাজার কমেন্ট পড়েছে। যার ৯০ শতাংশই রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হামলাকেন্দ্রিক।