ইতিহাস গড়া এক আলিঙ্গন
মাত্রই জানতে পারলেন, তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন স্ত্রীকে। ধন্যবাদ জানালেন পাশে থেকে সাহস ও সমর্থন জোগানোর। পরে টুইটারে ছবি শেয়ারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানল ওই মুহূর্তের চিত্র।
দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ধন্যবাদ জানানো এবং পরে ওই মুহূর্তের কথা সবাইকে জানানোর মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি হলো ভারতের রাজনীতিতে।
ভারতের রাজনীতির সমার্থক হলো আগ্রাসন বা আক্রমণ। এখানে আবেগ বা অনুরাগের কোনো স্থান নেই। কিন্তু কেজরিওয়াল এটিই জুড়ে দিলেন ভারতের রাজনীতিতে।
‘ধন্যবাদ সুনিতা’
ভারতে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। অতিসম্প্রতি দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে স্মরণকালের বড় জয় পেয়েছেন তিনি। প্রায় সব আসনেই জয়ী হয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি (এএপি)।
নির্বাচনে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর টুইটারে একটি পোস্ট দেন কেজরিওয়াল। এতে দেখা যায়, পরিবার ও সমর্থক পরিবেষ্টিত অবস্থায় স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়ালের কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। পোস্টটির কথা ছিল, সব সময় পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ সুনিতা। ‘নির্বাচনে জেতার পর সুনিতা কেজরিওয়াল ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রথম কয়েকটি ছবি।’ ছবিতে সুনিতাকে দেখা যায় লাজুক ও আরক্তিমভাবে।
ভারতের পুরুষতান্ত্রিক ও অভিজাত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে এই ছবি পরিপন্থী। তবে আবেগপূর্ণ এই মুহূর্ত অশ্রু এনেছে অনেক ভারতবাসীর চোখে। ভালোবাসা দিবসের যেকোনো মুহূর্তের সঙ্গে মিলে যায় এটি।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন এএপির অনেক সমর্থকের কাছেই সুনিতা কেজরিওয়াল অপরিচিত। কিন্তু স্বামী তাঁকে সমর্থনের ধন্যবাদ ঠিকই দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ কর পরিদর্শক হিসেবে স্ত্রীর চাকরির সুবাদেই সরকারি ফ্ল্যাটে থাকেন অরবিন্দ-সুনিতা দম্পতি। সরকারি কর্মচারী হওয়ার কারণে রাজনীতি নিয়ে বরাবরই কোনো মন্তব্য দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন সুনিতা কেজরিওয়াল।
এর আগে কেজরিওয়াল একবার বলেছিলেন সুনিতার সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের কথা। সুনিতার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয় ভারতীয় রাজস্ব বিভাগের এক প্রশিক্ষণে। কেজরিওয়াল একদিন হেঁটে সুনিতার কাছে গিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন।
টুইটারে সুনিতা ও কেজরিওয়ালের মুহূর্ত মনে করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামার টুইটার পোস্টের কথা। ওই পোস্টের ছবিতে স্ত্রী মিশেলকে জড়িয়ে ধন্যবাদ দেন ওবামা।
ওবামা সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেন, মিশেল তাঁকে প্রতিদিনই অনুপ্রাণিত করেন। ভালো মানুষ হওয়ার পাশপাশি একজন ভালো প্রেসিডেন্ট হওয়ার পেছনেও আছে মিশেলের অবদান।
পশ্চিমা বিশ্বের কোনো রাজনীতিবিদ স্বামী বা স্ত্রীর অবদানের কথা জনসমক্ষে স্বীকার করে। একই সঙ্গে তাঁদের মধ্যকার আবেগ সবার সামনেই প্রকাশে তাঁরা ভয় পায় না। কেজরিওয়ালের টুইটার পোস্টও এমন বার্তাই বহন করে।
ভালোবাসা নিষিদ্ধ
স্মরণকালের ইতিহাসে ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে রোমান্টিক ও বিয়োগান্তক গল্পটি হলো রাজীব গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধীর সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁদের প্রতিটি মুহূর্তের চিত্রে ছিল সতর্কতা। ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ।
অনেক ভারতীয়র মনে প্রশ্ন জাগে, রাজনীতিবিদরা কেন পরিবার নিয়ে সহজ হতে পারেন না। ভারতের রাজনীতিতে ব্যক্তিগত আবেগ ও ভালোবাসা প্রদর্শন এখনো কেন নিষিদ্ধ।
ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা শুধু জীবনসঙ্গীর অবদান স্মরণ করতেই ব্যর্থ নন, বরং রাজনীতিতে একে অনুপ্রবেশ হিসেবেই দেখা হয়।
স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কেজরিওয়ালের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পদক্ষেপের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবস্থান সম্পূর্ণ উল্টো। মোদি গত বছর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নিজের স্ত্রীর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে গেছেন। শুধু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর তিনি স্ত্রী থাকার কথা জানিয়েছেন। তবে এ ঘটনায় মোদির ভাবমূর্তির ক্ষুণ্ণ হয়েছে যৎসামান্যই। ভারতের রাজনীতিতে জনকল্যাণে সংসার ত্যাগকে শুধু উৎসাহিত করা হয় না, এর পুরস্কারও মেলে।
তবে মোদিকে এ নিয়ে সমালোচনার কোনো সুযোগ নেই। তাঁকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে তা ঠিক হওয়ার অনেক আগেই এই দম্পতি আলাদা হয়ে যায়।
রাজনৈতিক স্বচ্ছতা
স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভারতের রাজনীতি ও সমাজে একটি বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। রাজনীতিতে স্ত্রীর অবদানকে জনসমক্ষে স্মরণ করার মাধ্যমে তিনি সমতার বাণীই প্রচার করলেন।
কেজরিওয়ালের টুইটার পোস্টে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। নারীদের মন্তব্য ছিল ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। কেজরিওয়ালের টুইটার পোস্টে নিহারিকা ভাট নামে এক নারী মন্তব্য করেন, অবশেষে একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ পাওয়া গেল, যিনি স্ত্রী থাকায় লজ্জিত নন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক জে এম মানচন্দ্র মন্তব্য করেন, একজন ভালো রাজনীতিবিদ জনসমক্ষে তাঁর স্ত্রীর অবদান স্বীকার করে ধন্যবাদ দিতে পারেন।
স্ত্রীর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির ৬০ লাখ নারী ভোটারের আরো জনপ্রিয় করে তুললেন। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একে ভালো কৌশল বলবেন অনেকে।