যে চ্যালেঞ্জে কেজরিওয়ালের এএপি
কঠিনতম দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছি-আম আদমি পার্টির (এএপি) একজন সদস্য হিসেবে এমন দাবি করতেই পারি। কিন্তু এ ভাবনা ভুল। কঠিন দিনের সবে শুরু।
সামনের দিনগুলোতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। প্রত্যাশা যেখানে আকাশচুম্বী, ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাও সেখানে সমানুপাতিক।
৬৭ অসাধারণ সংখ্যা। এ সংখ্যা আশা ও স্বপ্নের। এটি এমন এক সংখ্যা, যা দিল্লির বাসিন্দাসহ গোটা ভারতবাসীর স্বপ্নপূরণের সুযোগ তৈরি করেছে। দুর্নীতি এর কাছে পরাজিত হবে; গড়ে উঠবে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ জন্য এএপিকে সাংগঠনিক শক্তির দিকে ফিরে তাকাতে হবে, কৌশল পুনর্নির্ধারণ করতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোকে সাজাতে হবে নতুন করে।
আমার মতে, এএপির সরকারকে ১০টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
১. বিকল্প রাজনীতির একটি মডেল তৈরি। শাসন করা ও প্রশাসন চালানো অনেক সহজ ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু দিল্লিবাসী আমাদের ৬৭টি আসন এ জন্যই দিয়েছে যে তাঁরা বিশ্বাস করে পুরোনো ধারার শাসন বদলে নতুন ঘরানা চালু হবে। কিন্তু প্রবাদ বলে, সাফল্যের আত্মবিনাশী যুক্তিও আছে।
স্বাধীনতা অর্জন ও প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই ভারতে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। ছয় দশকেরও বেশি সময় পর এটি পচে গেছে। এখানকার প্রতিষ্ঠিত মহল হীনস্বার্থ চরিতার্থ করেছে। সম্মিলিতভাবে সামগ্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। তাই এএপিকে শাসনের নতুন কাঠামো উপহার দিতে হবে। সফল হলে অদূর ভবিষ্যতে এএপিই হবে জাতীয় পর্যায়ে বিকল্প রাজনীতির সহজাত দাবিদার।
২. একটি শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতের বর্তমান গণতন্ত্রকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন রাজনীতিক। তাঁর প্রবাদ-প্রবচন অন্যদের থেকে ভিন্ন। সংসদ নির্বাচনে এএপির ভরাডুবির পর অরবিন্দ একদিনের জন্যও বসে থাকেননি। বিপরীতে রাহুল গান্ধী ভাগ্যের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি ধরেই নিয়েছেন ১৯৭৭ সালের পর পরিস্থিতি যেভাবে কংগ্রেসের অনুকূলে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই এটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি ‘সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা’ করে প্রহর গুনছেন। কিন্তু এএপির লোকজনের কৌশল হলো চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণকারী লোকজন অর্থাৎ ভোটারদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখা। এএপিকে অবশ্যই গণমানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। এমনটি করতে পারাই হবে দল ও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
৩. অতীতে অনেক কল্পকথাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে এএপি। সরকারে গিয়েও এ ধরনের কিছু বিষয়কে ভুল প্রমাণ করতে হবে। প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে হলে একটি স্বচ্ছ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর স্বচ্ছ সরকার গঠনের প্রথম নীতি হলো জবাবদিহিতা। এটি প্রশাসনে কিছু সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে বিকল্প রাজনীতির স্বার্থে এ সমস্যা বড় কিছু নয়।
৪. মন্ত্রীদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিভিন্ন মহল তাঁদের কার্যক্রম সব সময় পর্যবেক্ষণ করবে। ছোটখাটো ভুলকে ফলাও করে প্রচার করা হবে। গণমাধ্যমগুলো নির্দয়ভাবে তাঁদের নজরদারি করবে। এএপির মন্ত্রীরা অন্য দলের মন্ত্রীদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে পারেন না। কারণ নিজেদের জন্য ভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন তাঁরা। তাই অন্যের মানদণ্ড দিয়ে নিজেদের দেখতে চাওয়া হবে অনুচিত।
৫. এএপির বিধায়কদের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য। তাঁরাই হবেন জনগণের সঙ্গে দলের যোগাযোগের প্রথম মাধ্যম। তাঁরাই দলের মশাল বহনকারী। জনগণের সঙ্গে ব্যবহারই দলের ভবিষ্যৎ ও নিজ আসনে তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যেকোনো সেবা জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে হবে।
৬. সরকার ও দলকে একই সঙ্গে প্রতিযোগী ও পরিপূরক হতে হবে। সবচেয়ে বড় ভুল তখনই হয়, যখন সরকারের ক্ষমতার কাছে দল মাথা নত করে। যদি এএপি রাজনীতিতে নতুন মডেল দাঁড় করাতে চায়, তাহলে দলের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে হবে। দলের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকলে চলবে না।
৭. এএপি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ অনেক বেশি উন্মুক্ত হতে হবে। প্রশাসনকে অবশ্যই কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।
৮. এএপি ৭০ দফা কর্মপরিকল্পনা করেছে। এটিকে দলের ভবিষ্যৎ ও শাসন পরিচালনার মৌলিক ভিত্তি ধরতে হবে।
৯. স্বল্পমূল্যে পানি, শিক্ষা ও বিনামূল্যে ওয়াই-ফাই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এএপি; যাকে এক হাত নিতে পারে বিরোধীরা। তারা বলছে, এএপি পুরোনো ধারার সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ফিরে যাচ্ছে। আমরা জানি যে এটি সত্য নয়। এএপি বাজার অর্থনীতির একটি নতুন ধারা সৃষ্টির পক্ষে। কিন্তু এতে সমাজের মৌলিক চাহিদাগুলোকে আমলে নেওয়ার বিষয় থাকতে হবে। বাজারের সঙ্গে কল্যাণের যোগে একটি মিশ্র ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।
১০. সবশেষে বলতে চাই, সাংঘর্ষিক কিংবা বিরূপ পরিস্থিতিতে এএপিকে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। এক চিলতে হাসি দাম্ভিকতাপূর্ণ নীরবতার (সমালোচনার জবাবে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় যে কৌশল নিয়েছে) চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী। ভুল সংশোধনের ক্ষেত্রে ভদ্র ও বিনয়ী হতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে হবে, আমরা বিরোধিতা নয়, সহযোগিতার জন্য এসেছি। আমরা সমস্যা নয়, সমাধানের অংশীদার হতে চাই।
আমি বিশ্বাস করি, এটা সম্ভব। অরবিন্দ তাঁর প্রথম ভাষণে আমাদের অহংকার ছাড়তে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। অহংকার সবচেয়ে নেতিবাচক বস্তু যা সরকার, দল ও ব্যক্তিকে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
আমরা সেবার জন্য এসেছি। সবার দুয়ারে তা-ই পৌঁছে দেব।
সাংবাদিক ও লেখক আশুতোষ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এএপিতে যোগ দেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে তিনি দিল্লির চাঁদনী চক এলাকা থেকে সাবেক মন্ত্রী কপিল সিবাল ও বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনের বিপক্ষে লড়েছিলেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আজহারুল ইসলাম