ভারতকে মূল্য দিতে হবে, মাকে টাইগার মেমন
মুম্বাই বোমা হামলার ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মূল হোতা টাইগার মেমন তখন থেকেই ফেরারি। নেপথ্যেই ছিলেন সব সময়। বহুদিন পর আবার তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল মুম্বাই পুলিশ। ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড ফেরারি আসামি মুশতাক ‘টাইগার’ মেমন ফোন করেছিলেন নিজের বাসায়। ছোট ভাই ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মাত্র দেড় ঘণ্টা আগেই বাড়ির ল্যান্ডফোন লাইনে কথা বলেছিলেন তিনি।
ইন্ডিয়া টাইমসের খবরে পাওয়া গেল, এই কথোপকথনের পূর্ণাঙ্গ ট্রান্সক্রিপশন উদ্ধার করেছে মুম্বাই পুলিশ। টাইগারের মা এবং টাইগারের এই কথোপকথন যথেষ্টই সতর্কতার বা পাল্টা আঘাতের হুমকি হতে পারে বলে মনে করছেন পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারা।
কী বলেছিলেন টাইগার
ভাইয়ের মৃত্যু হতে যাচ্ছে, এ নিয়ে শোক বা বিলাপ করেননি টাইগার। মা এবং পরিবারের আরেক সদস্যের সঙ্গে এর ‘হত্যাকাণ্ডের’ প্রতিশোধ নিয়েই কথা বলেছেন তিনি। মুম্বাই পুলিশ এই আলাপচারিতা শোনে এবং একে টাইগারের কণ্ঠস্বর হিসেবে চিহ্নিত করে। মুম্বাই ও দিল্লির নিরাপত্তা সংস্থা থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়।
অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি (হোম) কে পি বকশি ইকোনমিক টাইমসকে জানান, এই আলাপচারিতার বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না। ‘মহারাষ্ট্র ডিজিপি (ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) কিংবা সেন্ট্রাল এজেন্সি থেকে এ রকম কিছুই জানানো হয়নি আমাদের,’ মন্তব্য করেন তিনি। মুম্বাই পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া এ বিষয়ে কোনো জবাব দেননি। তাঁকে মেসেজ করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
টাইগার এখনো যে তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় ইয়াকুবের আইনজীবী শ্যাম কেশ্বানিকে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ তিনি, ‘দয়া করে আমাকে এর মধ্যে টানবেন না। আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
টাইগারের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা; কিন্তু তাঁরা মুখ খোলা দূরে থাকুক, কোনো কথা বলতেই রাজি হননি।
টাইগার এবং তাঁ মায়ের কথোপকথন :
ভোর সাড়ে ৫টায় (স্থানীয় ৩০ জুলাই) মেমনদের বাসস্থানে ফোন আসে, ল্যান্ডলাইনে। ফোন কলার নিজের পরিচয় না দিয়ে দ্রুত বলেন—
‘সালাম ওয়ালাইকুম, হ্যালো।’
উত্তর : ওয়ালাইকুম সালাম, ভাই।
কণ্ঠ : আম্মি জাগ্যি হ্যায় ক্যয়া? (মা কি জেগে আছেন?)
উত্তর : ও রাতভর সোয়ি নেহি হ্যায়। (উনি সারা রাত ঘুমাননি)
কণ্ঠ : বাত কারাও। (আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই)
এর পর ৩০ সেকেন্ড কোনো কথা নেই। কর্ডলেস ফোন অন্য রুমে দিয়ে দেওয়া হয়। ফোন বহনকারী উত্তরদাতার কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘ভাইজান কা ফোন হ্যায়’ (বড়ভাই ফোন করেছেন)। তার পর দুবার শোনা যায়, ‘ভাইজান বাত করেঙ্গে’ (বড়ভাই কথা বলতে চান)। এর পর কিছু স্পষ্ট শোনা যায় না। সম্ভবত টাইগারের মা কথা বলতে অনিচ্ছা জানান, কণ্ঠস্বর বলে, ‘তুম বাত তো ক্যরো’ (তুমি কথা বলো)।
টাইগারের মা হানিফা মেমন এর পর ফোন ধরেন। তিনি অস্পষ্টভাবে কী বলেন, তা বোঝা যায় না। এর পর টাইগার বলা শুরু করেন।
টাইগার : সালামালাইকুম আম্মি।
এটুকু শুনেই টাইগারের মা কাঁদতে শুরু করেন। এর পর ৩৫ সেকেন্ড চুপচাপ। শুধু টাইগারের মায়ের ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যায়। তার পর কথা বলে ওঠেন টাইগার।
টাইগার : জুলম কি ইনতেহা হো গ্যয়ি হ্যায়। যায়া নেহি জায়েগা। (এই দণ্ড জুলুমের, এটা বৃথা যাবে না)।
এর পর আবারো বলেন টাইগার, ‘ইয়ে সব যায়া নেহি জায়েগা’ (এসব বৃথা যাবে না। এ কথা শুনে আবারো কাঁদতে থাকেন হানিফা। একটু থেমে আবারো কথা বলেন টাইগার।
টাইগার : তুম রো মাত আম্মি, ইসকা ইনকো ইযাফা দেনা হোগা (তুমি কেঁদো না মা, এর মূল্য এদের দিতে হবে)।
হানিফার কথা কিছুই বোঝা যায় না। এবারে শোনা যায় টাইগারের হুমকি।
টাইগার : ম্যায় উনকো চুকাওঙ্গা। (আমি এর শোধ নিয়ে ছাড়ব)
ইয়াকুবকে দেখতে পেলেন না, এই বলে বিলাপ করতে থাকেন টাইগারের মা। তারপর তিনি আবারো কাঁদতে থাকেন। তার পর বাড়ির কেউ (যিনি ফোন রিসিভ করেছিলেন) ফোনটা নিয়ে কথা বলে ওঠেন—
বাড়ির বাসিন্দা : ভাই...
টাইগার : উসকো সমহালো, সবকো সমহালো (ওকে সামলাও, সবাইকে সামলাও)।
বাড়ির বাসিন্দা জানান, বাড়ির সবাই কাঁদছে।
টাইগার : সবকে আসু যায়া নেহি জায়েঙ্গে। সবকো খেয়াল রাখো (কারো অশ্রু বৃথা যাবে না। সবার যত্ন নিও)।
এ কথা বলার পর বাড়ির বাসিন্দা টাইগারকে প্রার্থনা করতে বলেন। এরপরই ফোন কেটে যায়। এই কলটি করা হয়েছিল একটি বিশেষ ভিওআইপি সংযোগ থেকে, যেটি একের পর এক ইন্টারনেট প্রটোকল অ্যাড্রেস বাউন্স করে আসছিল, যে কারণে কলটি পুরোপুরি ট্রেস করা সম্ভব হয়নি।
টাইগার মেমন ও আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের মূল পরিকল্পনায় ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ মুম্বাই শহরের ১৩টি স্থানে বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় মৃত্যু ঘটে ২৫৭ জনের, আহত হয় অজস্র মানুষ। এটি এখন পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসে ভয়াবহতম সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসেবে চিহ্নিত।