স্কুলে কোনো বিষয় থাকবে না!
বড় রকমের পরিবর্তন আসছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায়। সেখানে গণিত, রসায়ন বা পদার্থের মতো কোনো বিষয় থাকবে না। এর বদলে থাকবে নির্দিষ্ট কোনো বস্তু বা সংগঠন সম্পর্কে জ্ঞান। যেমন- কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের ইতিহাস বা কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন কীভাবে ঘটে ইত্যাদি। শিক্ষাব্যবস্থায় এই ব্যতিক্রমী পরিবর্তনের প্রস্তাব বর্তমানে দেশটিতে কার্যকরের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
দীর্ঘদিন ধরেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বিখ্যাত। মানের দিক থেকেও এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশের রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে ফিনল্যান্ডে যান।
শিক্ষা-ব্যবস্থার পরিবর্তনে ফিনল্যান্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে এরই মধ্যেই বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এর ফলে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য—বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা উঠে যাবে। এর বদলে আনা হবে নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনবিষয়ক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লিসা পোহজোলাইনেন বলেন, দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে।
রাজধানী হেলসিংকির উন্নয়ন ব্যবস্থাপক পাসি সাইল্যান্ডার বলেন, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মকে কর্মজীবনের জন্য শিক্ষিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বর্তমান যুগের শিশুরা কম্পিউটারে পারদর্শী। আগে ব্যাংকে অনেক কর্মচারী দেখা যেত। বর্তমানে তা কমে এসেছে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিতেই শিক্ষাব্যবস্থার সংস্থার বা পরিবর্তন প্রয়োজন।
বর্তমানে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বিদ্যালয়ে কয়েক ঘণ্টা করে ভূগোল, বিজ্ঞান, ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয় হবে প্রাসঙ্গিক ও কেন্দ্রিক। যেমন একটি আলোচ্য বিষয় হতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ নিয়ে আলোচনায় থাকবে সংগঠনটি সম্পর্কিত সবকিছু—এর ইতিহাস, অর্থনীতি, অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক, ভাষা, ভূগোল সবকিছু। এভাবে পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন বিষয়ের সংমিশ্রণে যুক্ত আলোচ্য বিষয় তৈরি করা হবে।
আর শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায়ও আসবে পরিবর্তন। বর্তমানে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা কোনো কিছু ব্যাখ্যা করেন, এ সময় শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে শোনে, পরবর্তী সময়ে এর ওপর প্রশ্ন-উত্তর হয়। এমন ধারার পরিবর্তে আসবে শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে শিক্ষাদান। এতে বাড়বে তাঁদের যোগাযোগের দক্ষতা।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা কর্মকর্তা মার্জো কেইলোনেন চলতি মাসের শেষদিকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা নকশা জমা দেবেন। তিনি বলেন, শুধু হেলসিংকি নয় পুরো ফিনল্যান্ডেই পরিবর্তন আসবে। দেশের নতুন প্রজন্মকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতেই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বিশ্বের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় চরিত্র, উচ্ছলতা বা যোগাযোগের দ্ক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ কম। তাঁদের মতে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই পরীক্ষাকেন্দ্রিক। ক্লাস করো, পরীক্ষা দাও, ফলাফল দেখো ইত্যাদি। তবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প এখনো মানুষের কাছে অতটা গ্রহণযোগ্য নয়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা কর্মকর্তা মার্জো কেইলোনেন বলেন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষকদের আগ্রহী করে তুলতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ নেওয়া শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে।
রাজধানী হেলসিংকির উন্নয়ন ব্যবস্থাপক পাসি সাইল্যান্ডার বলেন, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষককেই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকে মনে করেন তাঁরা আর পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারবেন না।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে রাজধানী হেলসিংকির স্কুলগুলোতে পরিবর্তন আনা হবে। পরে রাজধানীর বাইরের স্কুলগুলোতে পরিবর্তন আনা হবে। আশা করা হয়, ২০২০ সালের মধ্যেই ফিনল্যান্ডের সব স্কুলে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। বাস্তবায়নের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যেই, স্কুলজীবন শুরু করতে যাচ্ছে—এমন শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হবে বিশেষ শিক্ষাদান ব্যবস্থা-প্লেফুল লার্নিং সেন্টার (পিএলসি) বা খেলার মাধ্যমে শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন খেলাধুলা ও কম্পিউটারভিত্তিক গেমের মাধ্যমে শিশুদের পাঠদান করা হবে। এরই মধ্যে কম্পিউটার গেম তৈরি করে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ শুরু করেছে।
পিএলসি কর্মসূচির পরিচালক ওলাভি মেনতানেন বলেন, শিশুদের পাঠদানকে আনন্দদায়ক খেলায় পরিবর্তন করার খেলাতে ফিনল্যান্ড অন্য দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের অনেক জাতি। পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ফিনল্যান্ডে সফল হলে অনেক দেশই এ অনুযায়ী তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে।