জিম্মি-বাণিজ্য বন্ধ, ফেলে যাওয়া অভিবাসীরা সাগরে
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশি দরিদ্র মানুষের ওপর নির্ভর করে দক্ষিণ এশিয়ায় মানবপাচারকারীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এই নেটওয়ার্ক মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছানোর কথা বলে পাচারকারীরা অভিবাসীদের কাছ থেকে যেমন অর্থ নেয়, তেমনি থাইল্যান্ডের বনাঞ্চলের বন্দী রেখেও অভিবাসীদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। তবে থাইল্যান্ডে সম্প্রতি গণকবর পাওয়ায় প্রশাসনের তৎপরতায় পাচারকারীদের কোটি কোটি ডলারের জিম্মি বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। আর এই কারণেই সাগরে মিলছে পাচারকারীদের ফেলে যাওয়া অভিবাসীবাহী নৌকা।
পাচারকারীদের কবলে পড়ে আন্দামান সাগরে কাঠের নৌকায় খাবার ও পানিবিহীন অবস্থায় নারী, শিশুসহ হাজারো বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেখতে পান এএফপির সাংবাদিকরা। গত শুক্রবার থাইল্যান্ডের কো লিপে দ্বীপ থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থান করলেও নৌকা থেকে অভিবাসীদের মাটিতে নামার কোনো অনুমোদন দেয়নি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, পাচারকারীরাও নৌকায় অবস্থান করছিল।
থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ অভিবাসী নৌকায় পানি ও খাবার দিয়েছে। একই সঙ্গে ইঞ্জিনও ঠিক করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশিবাহী নৌকা শুক্রবারই থাইল্যান্ড উপকূল ছাড়ে। বর্তমানে নৌকার অবস্থান অজানা। তবে ওই রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশিরা জানে না কবে তারা মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারবে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া যাওয়ার অনেক পরিচিত পথই বন্ধ করে দিয়েছে থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, পশ্চিম মিয়ানমারে পাচারকারীরা তৎপর। ওই এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করে রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা মুসলমানরা। একই সঙ্গে পাচারকারীরা বাংলাদেশের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলেও তৎপর। তাঁদের প্রাথমিক শিকার ভাগ্য পরিবর্তনে ইচ্ছুক দরিদ্র বাংলাদেশিরা। পাচারকারীরা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে চলে আসে।
চলতি বছরের শুরুতে পাচারকারীরা অত্যন্ত বেপোরোয়া হয়ে ওঠে। তারা বেশ সস্তায় এমনকি বিনা পয়সায় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের থাইল্যান্ডে নিয়ে আসে। এর কারণ ছিল জিম্মি-বাণিজ্য।
আন্দামান সাগরে নৌকায় থাকা রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, তিনি মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারলে তাঁর ভাই পাচারকারীদের এক হাজার ১২০ মার্কিন ডলার দেবে। এখনো পাচারকারীদের তিনি কোনো অর্থ দেননি বলে জানান।
মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলছে, পাচারকারীরা অনেক কম টাকায় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের এনে থাইল্যান্ডের জঙ্গলের ক্যাম্পে বেচে দেয়। পরে ওই ক্যাম্পের লোকেরা অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে দুই হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করে। এ ছাড়া প্রায় একই মূল্যে পাচারকারীরা অভিবাসীদের অনেক সময় মালয়েশিয়ার বড় খামার বা ব্যবসায় বিক্রি করে দেয়।
মানবপাচারবিরোধী সংগঠন ফ্রিল্যান্ড ফাউন্ডেশনের মতে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, জোরপূর্বক বা অপহরণ করেও যদি একটি নৌকায় ৪০০ মানুষও আনা সম্ভব হয়, তবে প্রতি মানুষে দুই হাজার মার্কিন ডলার আদায় করায় নৌকাপ্রতি পাচারকারীদের লাভ হয় প্রায় আট লাখ মার্কিন ডলার। তাই জিম্মি-বাণিজ্যকেই পাচারকারীদের মূল আয়ের উৎস বলা চলে।
গত ১ মে মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশি অভিবাসীদের গণকবর খুঁজে পাওয়া যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলে ৬০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। প্রায় একই সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়। এই পদক্ষেপের কারণে রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশিদের থাইল্যান্ডের জঙ্গলের ঘাঁটিতে এনে পাচারকারীদের বন্দী-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।
জঙ্গলে অভিবাসীদের গণকবর পাওয়ার ফলে থাইল্যান্ড পুলিশের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তাঁরা বরাবরই নিশ্চুপ থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি পাচারকারীদের কাছ থেকেও থাই পুলিশ মাসোহারা পায় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। স্থানীয় প্রশাসনের দিকেও অভিযোগের তীর যায়। থাইল্যান্ডের স্যাটার্ন প্রদেশের প্রভাবশালী কর্মকর্তা পাজ্জুবান অংকাছোটেপান ওরফে ‘বিগ ব্রাদাং টং’-এর বিরুদ্ধে পাচারকারীদের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে সন্দেহ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে পুলিশ।
সাটার্ন প্রদেশের এক ব্যবসায়ী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, প্রদেশের প্রতিটি বড় ব্যবসার জন্য টং-এর মাধ্যম হয়ে যেতে হয়। সে যুক্ত কি না, নিশ্চিত না হলেও ওই ব্যবসায়ী দাবি করেন, কেউ অবৈধ কিছু করলে অবশ্যই তা টং-এর জানার কথা। পুলিশি অভিযোগের পর থেকেই পালিয়ে আছেন টং।
থাইল্যান্ডে মানবপাচার ব্যবসা হাজার কোটি ডলারের। এর সঙ্গে যুক্ত থাইল্যান্ডের বাইরের অপরাধীরা। থাই কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস জানায়, অধিকাংশ পাচারকারীই মিয়ানমার বা মালয়েশিয়ার। তবে থাইল্যান্ডের অপরাধীরাও এই ব্যবসা থেকে বিপুল অঙ্কের লাভ নেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, ২০১২ সাল থেকে থাইল্যান্ডভিত্তিক মানবপাচার ব্যবসায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার করে লাভ হচ্ছে। এর মানে হলো এই ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ছোট-বড় অনেকেই জড়িত। আর এসব অর্থ আসে মিয়ানমার বা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান রাষ্ট্রহীন অবস্থায় আছে। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার মানুষ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমান সাগর পাড়ি দিতে পাচারকারীদের নৌকায় যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু চলতি মাসের শুরুতে থাইল্যান্ডে অভিবাসীদের গণকবর পাওয়ায় কঠোর হয়েছে থাই কর্তৃপক্ষ। এতে পাচারকারীদের সাজানো ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক পাচারকারী তাই অভিবাসীদের ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
কক্সবাজার অঞ্চলে তিন লাখ রোহিঙ্গার পাশাপাশি অনেক দরিদ্র বাংলাদেশি মানবেতর জীবনযাপন করেন। সেখানে অনেক পাচারকারীও তৎপর। গত ৮ মে কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন অভিযুক্ত পাচারকারী নিহত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দোলু হোসেন (৫৫) নামে এক ব্যক্তি পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন। মাত্র ২৫৫ মার্কিন ডলার করে নিয়ে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে সে নৌকায় পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ এএফপিকে বলেন, থাইল্যান্ডের গণকবরের ঘটনার পর বাংলাদেশি ১৬ দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি জানান, দালালদের অধিকাংশই আগে জেলে বা মাঝি ছিল। তবে অর্থের লোভে তারা মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে।
কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (২৫) বলেন, অনেক রোহিঙ্গাও মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কাকে দোষ দেবেন। এখানে কাজ পাওয়া কষ্টকর। তাই ঠিক-বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না।