মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ২৩ বছর, জের বয়ে বেড়াচ্ছে হতাহতদের স্বজনেরা
২০০১ সালের এই দিনটি ছিল বিভিষিকাময়। ভয়াবহ বিমান হামলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে। ছিনতাই করা বিমান দিয়ে হামলা চালিয়েছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আল কায়দা নেটওয়ার্কের ১৯ জন সদস্য। পৃথিবী কাঁপানো এই হামলা পরিচিতি পায় ৯/১১ হিসেবে। সেই হামলার ২৩ বছর কেটে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যে মামলাটি দায়ের হয়েছিল, তার রায় এখনও হয়নি। অথচ এখনও বীভৎস্য সেই দিনটির জের বয়ে বেড়াচ্ছেন ভুক্তভোগী এবং হতাহতদের পরিবারের স্বজনরা। খবর পলিটিকো ও সিএনএনের।
মার্কিন গণমাধ্যম দুটি বলছে, ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ারের একটি টাওয়ারে সরাসরি আঘাত হানে ছিনতাইকারীদের প্রথম বিমানটি। দ্বিতীয় বিমানটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয় এর অল্পক্ষণ পর, সকাল ৯টা ৩ মিনিটে। দুটি ভবনেই আগুন ধরে যায়। ভবন দুটির উপরতলায় মানুষজন আটকা পড়ে যায়। শহরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। দুটি টাওয়ার ভবনই ছিল ১১০ তলা। মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে দুটি ভবনই বিশাল ধুলার ঝড় তুলে মাটিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় বিমানটি পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে ছিল আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিভাগের বিশাল এই সদর দপ্তর পেন্টাগন ভবন। তারপর সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ বিমানটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার এক মাঠে। ছিনতাই হওয়া চতুর্থ বিমানের যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর সেটি পেনসিলভেনিয়ায় বিধ্বস্ত হয়। ধারণা করা হয় ছিনতাইকারীরা চতুর্থ বিমানটি দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল ভবনের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিমান ছিনতাইকারীদের মধ্যে ১৫ জন সৌদি আরবের, দুজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের, একজন মিশরের এবং একজন লেবাননের ছিল। তারা মোট চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেছিলেন তারা। এই চারটি গ্রুপের তিনটিতে পাঁচজন করে এবং একটিতে চারজন সদস্য ছিলেন। এই ছিনতাইকারীদের মধ্যে চারজন উড়োজাহাজ চালানোতে পারদর্শী ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিমান চালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কোর্স সম্পন্ন করেছিলেন তারা। ছিনতাইকারীদের প্রতিটি গ্রুপে তাদের একজন করে পাইলট ছিলেন। এই হামলায় ব্যবহার করা উড়োজাহাজ চারটির ২৪৬ জন যাত্রী এবং ক্রুর প্রত্যেকে নিহত হন। টুইন টাওয়ারের দুটি ভবনে নিহত হন দুই হাজার ৬০৬ জন এবং পেন্টাগনে নিহত হন ১২৫ জন। সব মিলিয়ে ভয়াবহ সেই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন মোট দুই হাজার ৯৭৭ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। হতাহতদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিকরা ছিলেন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুসারে, ৯/১১ হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল তৎকালীন তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে। তবে পরিকল্পনায় সৌদি আরবের তৎকালীন সরকারি প্রশাসনের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তাও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই হামলায় নিহত সর্বজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির নাম রবার্ট নর্টন। তার বয়স ছিল ৮২। তিনি ছিলেন অন্য আরেকটি বিমানে এবং তার স্ত্রী জ্যাকুলিনের সাথে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ নিহতের বয়স ছিল দুবছর। নাম ক্রিস্টিন লি হ্যানসন। তার বাবা মায়ের সাথে সে একটি বিমানের যাত্রী ছিল।
হামলার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নির্দেশে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে মার্কিন-ন্যাটো বাহিনী। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আল কায়দার তৎকালীন প্রধান ওসামা বিন লাদেন এবং হামলার অন্যান্য পরিকল্পনাকারীরা। প্রায় কাছাকাছি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতে সৌদির সরকারের কাছে দায়স্বীকার, ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন হামলায় নিহতদের আত্মীয়-স্বজন। আফগানিস্তানে অভিযান শুরুর ১০ বছর পর, ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বিমান বাহিনীর হামলায় নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। হামলার অন্যান্য পরিকল্পনাকারীদের প্রায় সবাই ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন, দু’একজন জন রয়েছেন গুয়ান্তানামা বে’ কারাগারে। কিন্তু সৌদি আরবের তৎকালীন প্রশাসনকে দায়ী করে মার্কিন আদালতে যে মামলা করা হয়েছিল, সেটির তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখনও এই মামলার রায় দেননি আদালত। সৌদি আরবও এ পর্যন্ত এই ইস্যুতে দায়স্বীকার তো দূর, আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশও করেনি।