আবৃত্তির লোকপ্রিয়তা ও কবিতা নিয়ে কথা
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/07/08/h_r_k_2.jpg)
আবৃত্তি নিঃসন্দেহে আর্ট, এ আর্টের মায়া ও মমতায় কার না হৃদয় মজে! কবিকে নেপথ্যে রেখে যে-মানুষটা তার বহুস্বরিক আনন্দ-বেদনাকে কণ্ঠে তুলে নিলেন, তাঁরও নিশ্চয় গভীর-গোপন আনন্দ-বেদনার একটা ভুবন আছে। আবৃত্তিকার ওই জায়গায় নতুন আবেগের সঞ্চালক। কবির ছায়ার চারুকলায় ঘনিষ্ঠ পড়শি।
খ.
এ প্রীতম পড়শিকে এ কালের কবি কী চোখে দেখেন? গত শতকের তিরিশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের বাংলা আধুনিক কবিতার একটা বৃত্ত বা পূর্ণতার পরিধি ভেবে নিয়ে বলা যায়, আবৃত্তিশিল্প ওই লক্ষণরেখার বাইরে আওয়াজ পৌঁছাতে বেশ কুণ্ঠিত এখনও। বিশেষ করে পঞ্চাশ ষাট সত্তর কিংবা তারও আগের কবিতার পংক্তিতে তাদের অবিরাম ঘোরাঘুরি এক ধরনের পরিতৃপ্তির বলয় তৈরি করে নিয়েছে বললে খুব কি বেমানান শোনাবে? এ তিন দশকের মধ্যে সত্তর আবার সবিশেষ উচ্চকণ্ঠ। অবশ্য বাঙালির স্বাধিকার স্পৃহা, মুক্তিযুদ্ধ, ৭৫-এর বিয়োগান্তক বেদনা, সমর শাসন, স্বৈরাচার ইত্যাকার জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষার ঘন সন্নিপাতে এ সময়ের অধিকাংশ কবিই স্লোগানমুখরতায় শামিল হতে অনেকটাই বাধ্য ছিলেন। এর সবই মান্য ইতিহাসের বিষয় আজ। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের কবিতা ওই বৃত্ত ভেঙে এগিয়েছে। দেশজ ও বৈশ্বিক ইতিবাচক প্রবণতাকে সঙ্গে নিয়ে। নতুন ইমেজে, নতুন পোশাকে।
গ.
কবিতার শরীর থেকে উচিতমাত্রার কোলাহল, অতিরেক বর্ণনা ও কাহিনিধর্মিতার মেদ ও বিস্তারকে ছেঁটে ফেলে নতুন নির্মিতির যে-বাঁক দৃশ্যমান হলো, তার নাম আশির দশক। এ সময়ের কবিরা আসন্ন একবিংশ শতকের স্বপ্নচ্ছায়া ও বস্তুমায়ার অঙ্গীকারে কবিতার ভেতরে নিয়ে এলেন সংহতি ও সমন্বয়ী সম্ভারের বঙ্গীয় উদ্ভাসন। তাঁরা গেলেন নিম্নবর্গীয় জীবনের ক্যানভাসে। আগেকার ভাসা-ভাসা উচ্ছ্বাস ও রাজনীতিমণ্ডিত ভালোবাসার কুহেলিকা মাড়িয়ে। ফলে এ কবিতা জীবনের খুব গভীরে, স্বল্পভাষী চেতনায়, নাতিদীর্ঘ উপমা-উৎপ্রেক্ষায় হৃদয়ের জটিল কথা বলল। পরিপার্শ্বের নির্ভীক ছবি আঁকল। বর্ণনার জাঁক, কাহিনির পেলবতা বিদায় নিল কবিতার এই নতুন অবয়বে। তাই আগেকার কবিতার অভ্যস্ত পাঠের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ বনিবনা কম।
ঘ.
আশির দশকে সূচিত বাংলা কবিতার ওই পরিবর্তন পরবর্তী নব্বই, শূন্য ও চলমান একবিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকেও কাজ করে যাচ্ছে গোপনে-গোপনে। তাই কবিতা হয়েছে নিম্নস্বরা, সুদূরসন্ধানী, অধিকতর মানবিক, নিম্নবর্গীয় ও পৃথিবীকে কাছে টেনে নেওয়ার প্রবণতাসম্পন্ন।
ঙ.
এ কবিতা ডায়াসে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক কাঁপন তোলে না শ্রোতা-দর্শকের কানে। এ বরং মনের গভীর তলে অনুরণন সৃষ্টিতে আনন্দ পায় বেশি। আশি এবং তার পরের কবিতা মজলিশি বা বৈঠকী ঘরানার আদি দেশিয়ানাকে ডাকছে নতুন করে। অর্থাৎ এ কবিতা উচ্চারণের তন্ময়মাত্রাকে গাঢ় করে তুলতে চায়। সম্ভবত সে কারণেই আশি এবং তার পরবর্তী কবিতাসমূহ আবৃত্তিকারদের গলায় ওঠে না তেমন। এ থেকে মনে হয়, আবৃত্তিশিল্পের প্রবহমানতা বজায় রাখতে দীর্ঘ, বর্ণনাময় ও কাহিনিধর্মী আগেকার কবিতাই ভরসা হয়ে থাকবে আরও কিছুদিন। অন্যদিকে, নতুন কবিতার আবৃত্তিযোগ্যতা নির্মিত হবে নতুন নিরীক্ষায়, নতুন মনোযোগের আলোয়—সেও হয়তো আরও কিছুকাল পর।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক