আম নিয়ে কথকতা

Looks like you've blocked notifications!

আম যে ফলের রাজা, এ নিয়ে বোধহয় কারো মতভেদ নেই। পাকা আমের কথা মনে হলেই জিভে জল এসে যায়। কত রকমের আম যে আমাদের রয়েছে, ভাবলে অবাক হতে হয়। দেশজুড়ে আমের জাতবৈচিত্র্য সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে। আকার আকৃতি স্বাদে বর্ণে গন্ধে একেকটি আমের রয়েছে একেক রকম বৈশিষ্ট্য।

বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আমের সম্পর্ক অনেকটা আমে-দুধে মাখামাখির মতো, যদিও আম মৈথিলি শব্দ।  আমের নাম কৃষ্ণের শতনামকেও ছাড়িয়ে যাবে। বাল্মীকি আমকে ‘চ্যুত’ বলেছেন, কালিদাস ‘আম্র’ আর বাৎস্যায়ন বলেছেন ‘সহকার’। সংস্কৃত ভাষায় আমকে আম্র, বাংলায় আম, তামিলে মানকে এবং ইংরেজিতে ম্যাঙ্গো বলা হয়। বাংলার প্রাচীন গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এই আম আমবু, ভারতচন্দ্রে আম, ঈশ্বর গুপ্তে আঁব, মাইকেলে রসাল নামে অভিহিত হয়েছে। মৎস্যপুরাণ ও বায়ুপুরাণে কালো আমের উল্লেখ আছে, যার রস পানে মানুষ অমরত্ব লাভ করে। ইংরেজি ‘ম্যাঙ্গো’ নামের উৎপত্তি নাকি তামিলের ‘ম্যাঙ্গাই’ থেকে। আম বা আম্র শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘সুখে ভোগ করা’। চ্যুতর তাৎপর্য রসের ক্ষরণ। বাৎস্যায়নে আমকে ‘সহকার’ বলা হয়েছে। আমকে আরবিতে ‘আম্বাজ’ ও ফারসিতে ‘আম্বা’ বলা হয়। মুঘল সম্রাট বাবর ও চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং আমকে যথাক্রমে ‘পোর-ই-হিন্দ’ ও ‘প্রিন্স অব ফ্রুট’ বলতেন। আমের অন্যান্য প্রতিশব্দ—মাকন্দ, মদির, সখ, কামাঙ্গ, সরস, মধুদূত, অঙ্গনপ্রিয়, পিকবল্লভ, মৃষালক ইত্যাদি। আম যে এই উপমহাদেশেরই ফল, তা স্বীকার করেছেন ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতাসহ অনেকে। আকবরই প্রথম আমের গুণে সরকারি সিলমোহর দেন। তিনিই দ্বারভাঙার নিকটে ‘লাখবাগ’ বাগানে এক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির আমের চারা লাগিয়েছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে আইন-ই-আকবরিতে আমের প্রজাতি-বিচিত্র লিপিবদ্ধ করা হয়।

আর এই আম জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে। বাংলার স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের অনুভূতির সঙ্গে আম ও আমগাছের সম্পর্ক আছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে যে বেদনার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল, ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয় এই আম্রকাননে। আমাদের জাতীয় সংগীতে আছে... ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে, ঘ্রাণে পাগল করে...’। এখানে আমগাছের উপস্থিতি দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে। এটা আমাদের সৌভাগ্য যে বিশ্বের অন্য কোনো দেশ আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেনি। আমের সুখ্যাতি ও প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে আমের বনজ প্রজাতি রয়েছে। সে অর্থে আমরা আমের আদি মালিক। আমগাছ চিরসবুজ, সুদর্শন ও দীর্ঘজীবী। আম আমাদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। আমপাতা হিন্দু ও বৌদ্ধরা ধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চায় বহুলভাবে ব্যবহার করে। আম আমাদের সাহিত্য ও লোকগাথায় নিবিড়ভাবে যুক্ত। পৃথিবীর অনেক দেশেরই জাতীয় বৃক্ষ রয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কানাডা ও জার্মানির জাতীয় বৃক্ষ হচ্ছে ওক গাছ। কানাডার ম্যাপল, ভারতের বট, পাকিস্তানের সেড্রাস ডিওডর, শ্রীলঙ্কার নাগেশ্বর, ভুটানের সাইপ্রেস, সৌদি আরব, লেবানন, আফগানিস্তান, ইতালি, নরওয়ে ও সুইডেনের খেজুরগাছ, লেবাননের সেডার এবং কিউবার জাতীয় বৃক্ষ কিউবান রয়েল পাম।

বাংলা সাহিত্যে যেমন আম নিয়ে গল্পের শেষ নেই, তেমনি লোক-ইতিহাসেও। সেসব গল্পের বেশ কিছু আমের নাম-রহস্য নিয়ে। গল্প, এবং গল্প হলেও সত্যি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনিতে আম জুড়ে আছে। শিশুশিক্ষার যে কয়টা বই তিনি লিখেছেন, তার প্রায় সবকটিতেই ফলের নাম মানেই আম। বীথিকার নিমন্ত্রণ কবিতায় লিখেছেন, ‘বেতের ডালায় রেশমি-রুমাল–টানা/অরুণবরন আম এনো গোটাতক।’ আমকে এমন ভালো না বাসলে সাহিত্যের আসল-নকলের তফাত বোঝাতে গিয়েও কি না রবীন্দ্রনাথের অমিত রায় বলে,  কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না যে, পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরোলে বলব না, ‘আনো ফজলিতর আম।’ বলব, ‘নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে।’ উপমহাদেশ তথা বিশ্ববিখ্যাত নারী জ্যোতিষী খনার বচনে বলা হয়েছে ‘মাঘে বোল, ফাগুনে গুটি, চৈত্রে কাটিকুটি, বৈশাখে আটি, জ্যৈষ্ঠে দুধের বাটি’। খনার এই প্রবচনটি ছিল বাংলাদেশে আমের মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা এবং দুধ-মিষ্টি দিয়ে আম খাওয়ার সময়সীমা।