একজন দেবেশ রায়...
তিস্তাপারে এখন বিরাজ করছে অন্য রকম শান্তি। লকডাউনের জন্য অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে হাজির এখন তিস্তা। এ সবকিছুর মাঝেই চিরকালের জন্য চলে গেলেন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র সৃষ্টিকর্তা বিশিষ্ট সাহিত্যিক দেবেশ রায়। তাঁর অসংখ্য কালজয়ী উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ পেছনে রেখে চলে গেলেন তিনি। ‘বাঘারু তিস্তাপার ও আপলচাঁদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাদারিও তার সঙ্গে যাচ্ছে। যে-কারণে তিস্তাপার আপলচাঁদ থেকে শালবন উৎপাটিত হবে—সেই কারণেই বাঘারু উৎপাটিত হয়ে গেল। ... এ বৃত্তান্ত এখানেই শেষ। এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে বাঘারু মাতারিকে নিয়ে হাঁটুক, হাঁটুক, হাঁটুক...।’
তাঁর ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাস এখানেই শেষ হয়। কিন্তু প্রান্তজনের এসব লড়াই শেষ হয়েও শেষ হয় না। এসব পীড়িত, উৎপাটিত মানুষের কথা তিনি বলেছেন আমৃত্যু। জন্ম বাংলাদেশে হলেও বড় হয়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। রাজনীতিতে হাতেখড়ি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর ট্রেড ইউনিয়নের দক্ষ নেতা হয়ে ওঠা। প্রত্যন্ত মানুষের সঙ্গে নিজেকে উজাড় করে মিশতেন বলেই দাঙ্গার প্রতিবেদন, খরার প্রতিবেদন, শিল্পায়নের প্রতিবেদনের মতো ক্ষুরধার লেখা পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যেত। তিনি নিজেকে বলতেন, ‘আমি জলপাইগুড়ির ছেলে। বলতে পারো উত্তরবঙ্গেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য, পার্টির নেতা...মন খারাপ করার সময় আমার ছিল না।’
‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’, ‘দুপুর’, ‘পা’, ‘কলকাতা ও গোপাল’, ‘পশ্চাৎভূমি’, ‘ইচ্ছামতী’, ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’, ও ‘উদ্বাস্তু’—এই আটটি গল্প নিয়ে দেবেশ রায়ের প্রথম গল্পের বই বেরিয়েছিল। ১৯৭৯ সাল থেকে তিনি এক দশক ‘পরিচয়’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যযাতি’। তাঁর রাজনৈতিক বীক্ষার ছাপই পড়ে সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-তে। উত্তরবঙ্গের জীবনের বহতা ধরা আছে এই উপন্যাসে। শ্রী রায় বাস্তববাদী উপন্যাসের প্রচলিত ছক থেকে সরে গিয়ে বহুস্বরকে নিয়ে আসেন। বাংলা উপন্যাস ও গল্পে নিজের স্থান বহু আগেই পোক্ত করেছিলেন। বাংলায় উপন্যাস চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি এখন পর্যন্ত একক। অসীম রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার ও হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাস নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন; কিন্তু আস্ত বই লেখার কথা চিন্তা করেননি। সেখানে দেবেশ রায় তিনটি বই লিখেছেন, যেগুলোর উপজীব্য হলো বাংলা উপন্যাসের সংকট এবং বইগুলোতে দেখানো হয়েছে বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনাগুলোও। দেবেশ রায় ভেবেছেন বাংলা গদ্যের আদি, অন্ত ও বর্তমান নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবনমিত ছিলেন চিরদিন। শোনা যায়, দিনে ১৫ ঘণ্টা পড়তেন, লিখতেন। একই বাসায় তিন জায়গায় তিন রকমের লেখা লেখার জায়গা ছিল। ডাক্তারের নির্দেশে লেখাপড়া কমিয়ে আনলেও সেটি ১০ ঘণ্টার নিচে বলে নামানো সম্ভব হয়নি। রুশ সাহিত্যের সব মাস্টার ছিলেন তাঁর পরমপ্রিয়; পুশকিন, গোগল, তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্তি, তলস্তয়, চেখভ, শলোখভ আরো কত নাম। কেবল বিশ্বসাহিত্য নয়, সমস্ত ধরনের জ্ঞান বিদ্যায় আগ্রাসী আগ্রহ তাঁর।
দেবেশ রায় বলতেন, ‘সব ব্যাপারেই তো সাহেবদের চেয়ে পিছিয়ে আছি, তাই বলে জগৎ-জীবন বোঝার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকব?’ ফলে জগতের যেখানে যেকোনো ভাষার কোনো ভালো বই লেখা বেরিয়েছে জানলে সেটির ইংরেজি অনুবাদ বেরোনোর অধীর অপেক্ষায় থাকতেন, আর বের হওয়ামাত্র তা জোগাড় করে পড়ে ফেলতেন। কোনো আলংকারিক অভিধায় তাঁকে ধরে ফেলবার মতো লেখক দেবেশ রায় ছিলেন না। অলংকার, তাঁর কথায় এক বিপজ্জনক অবলম্বন। সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসের গ্রন্থবন্ধন অংশে তিনি এ কথা লিখেছেন। লিখেছেন, অলংকার ‘যুক্তির চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক। যুক্তির পাল্টা যুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু অলংকারের পাল্টা অলংকার দেওয়া যায় না। দেওয়া যায়, যদি অলংকারটাকে চকিতে যুক্তিতে বদলে নেওয়া যায়। সে বড় হাঙ্গামা।’
যদি নিকষ সত্যি কথাটা বলা যায়, তাহলে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের কেউ, দেবেশ রায়ের পর সে হাঙ্গামা পোহাননি। দেবেশ রায়, আক্ষরিক অর্থে এবং সর্বস্তরে হাঙ্গামা পুহিয়েছেন। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে একবার দেবেশ রায় বলেছিলেন, ‘যত বেশি ইংরেজিতে অনুবাদ্য লেখা যেন তত ভালো।’ এই পাশ্চাত্যমুখী ভালোত্বের জড় থেকে নিজের লেখাকে অতিক্রম করার এক অবিরল ধারা তাঁর প্রতিটি লেখায় উৎকীর্ণ, যা কোনো প্রয়াস নয়, যা কোনো চেষ্টা নয়, যা ফল্গু ধারার মতোই বহমান। এবং নিজের লেখার ভাষাকে তিনি যে মুক্তি দিতে চেয়েছেন, তার সঙ্গে ভিনদেশের সাহিত্যের কোনো অমিত্রতা ছিল না। অতীব হাতেগোনা কয়েকজনই হয়তো জানেন, দেবেশ রায় অনুবাদ করেছেন শেকসপিয়র এবং শেকসপিয়রের যে-সে বই নয়, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের মতো বইও। সে বইয়ের ভূমিকার প্রথম লাইন, ‘অবিরত অকারণ মৃত্যুর তাড়া খেতে খেতে আমাদের প্রজন্মের জীবন কাটল।’