একজন নজরুল ইসলাম

Looks like you've blocked notifications!

কাজী নজরুল ইসলাম এক বাঁধভাঙা প্রতিভা। লেখালেখিতে যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমনি তাঁর জীবনও হাঁটেনি চেনা পথে। লেখালেখি ও জীবনযাপন মিলিয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী। একজন মানুষকে চেনা আর তাঁকে জানার মধ্যে ব্যবধান ঠিক কতটা, সেটা বুঝতে কখনো কখনো আমাদের পুরো জীবন লেগে যায়। বিস্তর এই ব্যবধান পেরিয়ে ঠিক আসল মানুষটার কাছে পৌঁছানো অতটা সহজ নয়, যতটা আমরা ভাবি। এমনটা প্রায়ই হয়, একটা মানুষ বারবার আমাদের সামনে এলেও তাঁর সঙ্গে আমাদের শুধু পরিচয়ই থেকে যায়, তাঁকে জানা হয়ে ওঠে না কখনো।

কাজী নজরুল ইসলাম এমনই একটা নাম আমাদের কাছে। একদম ছোটবেলায় এই নামটার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, সে পরিচয় থাকে জীবনের শেষ পর্যন্ত। আমাদের দেশের জাতীয় কবি তিনি। তবু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেশিরভাগ সময়ই নজরুলকে জানা আমাদের আটকে থাকে পাঠ্য বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু লাইনে। কবি হিসেবে তিনি কত বড়, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তিনি তাঁর বিশিষ্টতায় সমুজ্জ্বল—তিনি একক ও অনন্য। সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা তিনি অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন, কারণ অন্যরা যেখানে শুধুই কবি, তিনি সেখানে তাঁর সৃষ্টির চেয়েও মহত্তর এক ব্যক্তি, তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা এবং ইতিহাসের এক পর্বের নায়ক। সমকালকে এভাবে আলোড়িত অভিভূত আর কোনো কবি করেননি।

নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। সাধারণত মনে করা হয় দারিদ্র্যের প্রবল কষাঘাতে তাঁর শৈশব পার হয় বলে তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। কিন্তু আসলে মা জাহেদা খাতুনের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পরে নজরুলের জন্ম হয় বলে শিশুকালেই তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। ছেলেবেলায় তিনি ‘তারা ক্ষ্যাপা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরে ‘নুরু’ নামও তিনি ব্যবহার করেছেন। সিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক এবং যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটক কিশোর নজরুলের মধ্যে স্বাধীনতা এবং বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার করেছিলেন। বিপ্লবী কর্মতৎপতার জন্য একসময় এই শিক্ষকের বিচার হয়। আর বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ আছে সন্দেহে দশম শ্রেণির সেরা ছাত্র নজরুলের মাসিক পাঁচ টাকা হারে ছাত্রবৃত্তি কেড়ে নেওয়া হয়, যদিও পরে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বৃত্তি পুনরায় অব্যাহত রাখা হয়।

করাচি সেনানিবাসে কঠোর  শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও তরুণ নজরুলের সাহিত্য-সংগীত অনুরাগী মন শুকিয়ে যায়নি, বরং অদম্য আগ্রহে পথ খুঁজে নিয়েছে। প্রাণবন্ত হৈ-হুল্লোড়ে আসর জমাতেন বলে সেনানিবাসে তিনি ‘হৈ হৈ কাজী’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া শুরু হলে নজরুল স্থায়ীভাবে করাচি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৭ জুন, ১৯২১ সাল শুক্রবার গভীর রাতে নজরুলের সাথে নার্গিসের আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু অত্যন্ত অভিমানী নজরুল একটি রাতও তাঁর নতুন বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে পার করেননি। কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় জবরদস্তিমূলক শর্ত আরোপ করেন যে নজরুল নার্গিসকে দৌলতপুর ছেড়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। অন্যায় এই বৈবাহিক শর্তে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল কনেকে গ্রহণ না করে ভোর হওয়ার আগেই চিরদিনের জন্য দৌলতপুর ছেড়ে আসেন এবং হেঁটে কুমিল্লায় পৌঁছান। বিয়ে ভেঙে গেলেও নজরুল কখনো এর জন্য নার্গিসকে দায়ী করেননি। নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের রাতেই নজরুল অভিমানে ক্লান্ত মন নিয়ে কর্দমাক্ত পথে ১০-১১ মাইল হেঁটে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের বাড়িতে আসেন। এখানে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের জেঠাইমা গিরিবালা দেবীর কন্যা কিশোরী  আশালতার (ডাক নাম দুলি/দোলন এবং পরে নজরুলের দেওয়া নাম প্রমীলা) প্রতি নজরুল অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

‘আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান’ কাজী নজরুল ইসলামের এই বাণী তাঁর জীবদ্দশাতেই আংশিকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি তরুণ বয়সেই বাঙালি জাতির জাতীয় কবির সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন। পরে তিনি হয়েছেন বাঙালির স্বাধীন-সার্বেভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বমানবতাবাদের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কবি। তিনি কবি-সংগীতকার হিসেবে শিল্প-সাহিত্য-গান-প্রবন্ধে সমগ্র মানবজাতির ঐক্যের অগ্রদূত। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বনাগরিক এবং কবিতা-গানে বিশ্বমানবতাবাদী কবি।

নজরুল এক অভিভাষণে বলেছেন, ‘এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল সমাজের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা আমার সাধনা। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।’ 

আপন দেশ জাতি এবং একই সঙ্গে বিশ্বমানুষের প্রতি এমন দায়বদ্ধ কবি পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আর জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি কবিতায় উদার মানবিকতাবাদ ও সর্বমানবতাবাদের জয়গান রচেছেন। তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খিস্টান-পারসিক-অগ্নিউপাসক-ইহুদি-নৃতাত্ত্বিক উপজাতি সবাইকে একই চোখে দেখেছেন এবং সবার মহামিলনের অভিন্ন মোহনা রচেছেন। ‘গাহি সাম্যের গান। যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম খ্রীশ্চান। কে তুমি?—পার্সি? জৈন ? ইহুদী? সাঁওতাল ভীল, গারো? কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বল আরো! বন্ধু, যা খুশি হও, পেটে-পিঠে কাঁধে-মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও, কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবলে-ত্রিপিটক- জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থ-সাহেব পড়ে যাও যত সখ,– কিন্তু কেন এ পণ্ড শ্রম, মগজে হানিছ শূল?’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই আমার প্রণতি।