কবিতা ও চিত্রকলার অপূর্ব মেলবন্ধন
আমার মতে একজন কবি তাঁর ভাবনা, মনের আখ্যান-ব্যাখ্যান প্রকাশ করে থাকেন তাঁর কবিতায় শব্দ ও ছন্দের মধ্য দিয়ে।কখনও সেখানে ফুটে ওঠে আনন্দ, বেদনা কিংবা তাঁর চারপাশে ঘটে যাওয়া পারিপার্শ্বিক ঘটনা। আবার অনেকটা লুকোচুরিও খেলেন বটে। যেমন কবিতার মধ্যে শব্দের আড়ালে কবি তাঁর বক্তব্য ও কল্পনা আশ্রিত রূপকে মূর্ত করতে চান। কিন্তু ভাষাটা প্রকৃত অর্থে কবির উপাদান নয়, শুধু সংকেত। সেই সংকেতটাকে বিশ্লেষণ করে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা দূরহের কাজ। কিন্তু যখন কবিতাসমূহ একজন দক্ষ চিত্রশিল্পীর নিপুণ হাতের মধ্যে দিয়ে রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার ব্যবস্থা নেন,তখন তাতে জটিল বলে কোনও শব্দের উপস্থিতি থাকে না। বরং আরও জীবন্ত-সজীব হয়ে ওঠে কবিতাসমূহ।
আমাদের চট্টগ্রামের বেশ কয়েক জন প্রবাদপ্রতিম, আমার প্রিয় কবিদের লেখা কবিতাসমূহ নিদারুণ শৈল্পিক হাতের স্পর্শে রংতুলির সহজ-সরল স্পর্শে ক্যানভাসে সেসব কবিতা চিত্র রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন, আমাদের সবার প্রিয় কবি ও চিত্রশিল্পী অজয় সেন চৌধুরী।
স্বাভাবিকভাবে শিশুকাল থেকে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠার কারণে এমন গুণী মানুষদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, পাশাপাশি তাঁদের ছায়ায় বড় হয়েছি। অজয় আঙ্কেল যেমন গুণী তেমনি অমায়িক, আন্তরিক, নিবেদিত প্রাণ এক প্রকৃত শিল্পী। যে কয়েক বার বাড়ি গিয়েছি, দেখেছি রংতুলি হাতে বিরামহীনভাবে ক্যানভাস রাঙিয়ে যাচ্ছেন, ঘরময় ছবিরা যেন কথা বলে যায়। অজয় আঙ্কেলকে নিয়ে খুব বেশি কিছু বলব না, আঙ্কেলকে নিয়ে কমবেশি প্রায় সবাই জানেন। আজ বেশ কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া আঙ্কেলের ব্যতিক্রমী চিত্রপ্রদর্শনী ‘অন্ত্যমিলে এই বিকেলে’ নিয়ে কিছু বলব। যেখানে ক্যানভাসজুড়ে কথা বলেছে কবিতারা ছবি হয়ে। দুর্ভাগ্যবশত অধ্যয়নের কারণে ভারতে অবস্থানের কারণে এই ব্যতিক্রমী চিত্রপ্রদর্শনীতে আমার অংশগ্রহণ করা হয়নি। এখনও তো বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হইনি, তাই পোস্টার ও ফোল্ডার দেখে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা অনুভব করেছি তা প্রকাশের চেষ্টা করব। কারণ, কেন জানি না এমন গুণী মানুষটিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য মনটা ভীষণ ব্যাকুল হয়ে আছে। তাই সেটি কলমের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে চাই।
ভারতে বসে আমি এ প্রদর্শনীর সংবাদ পেয়ে যেমন আপ্লুত হয়েছিলাম আবার তেমনি অভিমানও করেছিলাম। আপ্লুত হয়েছিলাম ব্যতিক্রমী এই চিত্রপ্রদর্শনীর খবর পেয়ে, অভিমানটা হলো কাছে গিয়ে উপভোগ করতে না পারার, ছবিগুলোকে ছুঁতে না পারার। যদিও বা আঙ্কেলের মেয়ে নৃত্যশিল্পী অর্জিতাদি এই বিষয়ে তথ্য দিলে মনের মধ্যে আরও তীব্র বাসনা জাগে, ইশ, যদি দেখতে পারতাম! কিন্তু কী করার। ভাগ্য হলো না। সত্যি ব্যতিক্রমী এক জগৎ উপহার দিয়েছেন শিল্পপ্রেমীদের, সেই সাথে এটি আরও আনন্দের হয়ে ওঠে যখন দেখি শিশুকাল থেকে দেখে আসা সব প্রিয় কবিদের লেখা কবিতাকে চিত্ররূপে ফুটিয়ে তুলেছেন আঙ্কেল। এখানেই শেষ নয়, নান্দনিক ক্যানভাসে কবিতায় উল্লেখিত প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি সব মিলেমিশে একাকার হয়েছে। বাবার কাছ থেকে শুনেছি আঙ্কেল শুধু চিত্রশিল্পী নন, একাধারে কবি ও ছড়াকারও বটে। তিনি আশির দশক থেকে লিখে আসছেন কবিতা। তবে এবার সত্যিকার অর্থে আঙ্কেল ক্যানভাসেরও কবি হয়ে উঠেছেন।
কবি স্বপন দত্তের ‘চন্দনা পাখির নামে নাম’ কবিতাটিতে কবি হয়তো প্রকাশ করেছেন ‘কোন এক অচিন পাখি লুকিয়ে থাকে মানুষের হৃদয়ের গভীরে, কেউ তা বোঝে আবার কেউ বুঝে উঠতে পারে না।’ অন্যদিকে কবি সনজীব আঙ্কেলের ‘নোঙর’ কবিতাটি চিত্রে ধূসর রঙের প্রয়োগ ঘটিয়ে অনন্য এক মায়াবি পরিবেশের সৃষ্টির করেছেন। ময়ূখ চৌধুরীর ‘আগুন’ কবিতাটি ক্যানভাসে ধূসর রঙে রাঙিয়ে যে এক রঙের ঝড় তুলেছেন তা অতুলনীয়। কবি ওমর কায়সার আঙ্কেল তাঁর ‘ডাঙার ভুবন’ কবিতার এক অংশে লিখেছেন ‘তারপর রুপালি ঝিলিক দিয়ে ফিরে যাও জলের আবাসে’ এই অর্থটি ক্যানভাসে দেখে মনে হচ্ছে ‘কেউ যেন রূপালি ঝিলিক দিয়ে ফিরে গেছে’। কবি সেলিনা শেলীর ‘আত্মগত’ কবিতার পাখিটা যেন আপন মনে গত জন্মের কথা স্মরণ করছে। কবি জিল্লুর রহমান আঙ্কেলের লেখা সদ্য প্রয়াত সবার প্রিয়; হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন আঙ্কেলকে নিয়ে লেখা যেখানে ক্যানভাসে কবিতাটি সত্যিকার অর্থে বেদনাবিধুর শব্দ ছড়াচ্ছে, বাদকের শূন্যতা ও ছন্দপতনে যেন ভারী হয় ক্যানভাস। আরও অনেক গুণী কবির কবিতা ফুটিয়ে তুলেছেন আঙ্কেল।
এমন একজনকে শিল্পীকে শিশুকাল থেকে দেখে বড় হওয়া, তাঁর শিল্পকর্মগুলো উপভোগ করতে পারার সুযোগ আমার কাছে পরম প্রাপ্তি ও আশীর্বাদ।
এই অভাবনীয় চিত্রপ্রদর্শনী স্বচক্ষে দেখতে না পারলেও হৃদয় দিয়ে শিল্পের এক স্বাদ ও তৃপ্তি অনুভব করেছি, কিছু শেখার চেষ্টা করেছি।
কৃতজ্ঞতা আমাদের সবার প্রিয় কবি, ক্যানভাসের কবি ও চিত্রশিল্পী অজয় সেন চৌধুরী।