কামাল চৌধুরীর কবিতায় প্রকৃতি জিজ্ঞাসা

Looks like you've blocked notifications!

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। জীবন-প্রাণের উৎস এবং আশ্রয়ও প্রকৃতি। মানুষের জীবনধারণ, বিবর্তন, আর্থিক ভিত্তি নির্মাণ, সমাজকাঠামো, পারস্পরিক লেনদেন, প্রাণ ও পরিবেশ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সভ্যতার মৌল উপাদানও প্রকৃতি থেকে আহরিত বা প্রকৃতিলগ্ন। ব্যক্তিমানুষ ও সাংস্কৃতিক বিচিত্রতার নির্মাণ এবং অভিব্যক্তি প্রকাশেও প্রকৃতি বাক্সময়। প্রকৃতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য রঙ-রেখা-রূপ-বাণীতে বিকশিত বাঙলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলার প্রতিটি ক্ষেত্র। কামাল চৌধুরীর ‘মিছিলের সমান বয়সী’ (১৯৮১), ‘টানাপোড়েনের দিন’ (১৯৯১), ‘এই পথ এই কোলাহল’ (১৯৯৩), ‘এসেছি নিজের ভোরে’ (১৯৯৫), ‘এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা’ (১৯৯৭), ‘ধূলি ও সাগর দৃশ্য’ (২০০০), ‘রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল’ (২০০৩), ‘হে মাটি পৃথিবীপুত্র’ (২০০৬), ‘প্রেমের কবিতা’ (২০০৮), ‘পান্থশালার ঘোড়া’ (২০১০) এবং ‘ভ্রমণ-কাহিনি’ কাব্যও (২০১৫) প্রকৃতির বাইরে নয়। তবে জীবন-জগৎ কিংবা শিল্প নির্মাণে প্রকৃতিকে তিনি কীভাবে কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন, তার মূল জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র কী কী, তা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

বাংলা কবিতার কালানুক্রমিক বিবেচনায় স্পষ্ট, কবিরা নানা সময়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। আধুনিকতার অন্যতম প্রবর্তক ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার যেমন প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেননি, তেমনি তিরিশোত্তর আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম কবি বুদ্ধদেব বসুও রূপ-রস-গন্ধমুখর প্রকৃতির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে লিখেছেন, ‘প্রান্তরে কিছুই নেই; জানালায় পর্দা টেনে দে’। এ সময়পর্ব থেকে বাংলা কবিতায় জোরেশোরে নানা ইজমের চর্চাও শুরু হয়। নিজেদের ‘বাস্তববাদী’, ‘সংশয়বাদী’ কিংবা ‘মার্কসবাদী’ চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে অনেক কবি প্রকৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃতিচর্চাকে ‘তথাকথিত’ রোমান্টিক ঘরানা আখ্যা দিয়েছেন। এর পরও প্রকৃতিতে অপার ডুবে থেকেছেন তিরিশের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ। কবি কামাল চৌধুরীর কবিতাও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য পরিগ্রহ করেই পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়। রোমান্টিকতার অনিবার্য উপাদান হিসেবে ফুল, চাঁদ, নদী, জ্যোৎস্না, শৈশবকাতরতা, নস্টালজিয়া, নারীপ্রেম, যুদ্ধ, বাউণ্ডুলেপনা ইত্যাকার থিম ব্যাপকভাবে কবিতায় চর্চিত। বাংলা কবিতাকে প্রকৃতসম্ভূতও বলা হয়ে থাকে। তবে প্রকৃতিজাত উপাদান-উপকরণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কামাল চৌধুরীর স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তার কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে :

‘আজ বাতাসের মন খুব ভালো
আজ তার বেড়াবার শখ
মাঝরাতে নক্ষত্র জ্বেলেছে আলো
জোছনা ঠিকরে পড়ে রাত্রির উদ্যানে
পাতা নড়ে নিজের মর্মরে
ঝড়ো বাতাসের টানে।’
(আজ বাতাসের মন/এই পথ এই কোলাহল)

একজন কবির উন্মেষকাল তার কবিতা বোঝার জন্য জরুরি হতে পারে। কবি কামাল চৌধুরীর কাব্য উন্মেষকাল হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালকে বিবেচনায় নেওয়া সঙ্গত। বাঙালির জাতীয় জীবনের জন্যও এই সময়পর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ একজন কবিকে দ্রুত চিন্তার গভীরে পৌঁছে দেয়। তাই কবির উত্তরণ সময়ের সঙ্গেই বেগবান। কামাল চৌধুরীর কবিতাও ধারণ করে আছে তার সময়পর্বে দেশ ও মাতৃকার নানাবিধ অসঙ্গতি, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড, সামাজিক ন্যায়হীনতা, দুষ্ট ক্ষতসহ নানা বিষয়াদি। এসব বিষয়াদি কবিতায় পরিবেশনের কৌশল হিসেবে তিনি প্রকৃতিকে আশ্রয় করেছেন। তার ‘স্নানঘর’ কবিতাটি লক্ষ্য করি :

‘আজ জরুরি হয়ে পড়েছে বৃষ্টির মুখোমুখি হওয়া
আজ নিজের ভেতর ভেজা শালিকের দ্রোহকাল।
অনন্ত স্নানঘরে আমাদের যৌথ আকাশ
বর্ষাতি হারিয়ে ফেলা বালক, তোয়ালেতে মুখ
মোছার আগে নড়ে উঠছে বানভাসি পাতার শব্দ
তাই নিয়ে আমাদের দূর অবগাহনের দিন—
ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে সাঁতার শেখা খাঁড়িমুখ
ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ভেজা শরীরের স্বেদবিন্দুর চিৎকার
সেখানে মুখোমুখি আয়না ও আর্দ্র কাক
ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার আগে ঝাঁপ দিচ্ছে
বর্ষাঋতুর বাঙালপনায়।’

প্রকৃতপক্ষে কবিতার বিষয়বস্তু কী হবে, কবিতায় আধুনিকতার বিনির্মাণ কিংবা চৈতন্যের প্রসার কীভাবে ঘটাবেন, তা সম্পূর্ণই কবির চেতনাজাত। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, সাহিত্যের শুদ্ধতম শিল্প কবিতায় এমন কোনো বিষয়বস্তু নেই যার সাক্ষাৎ মেলে না। কবিতা জীবনমুখী হলে, এক কথায় জীবনঘনিষ্ঠ প্রপঞ্চ সসম্ভ্রমে উঠে আসে কবিতার পঙক্তিতে। কামাল চৌধুরীর কবিতায়ও জীবন উঠে আসে অত্যন্ত সসম্ভ্রমে, প্রকৃতির মোড়কে।

কামাল চৌধুরী ‘মিছিলের সমান বয়সী’ কবিতাগ্রন্থ নিয়ে কাব্যমাঠে পদার্পণ করেছিলেন। ওই গ্রন্থের ‘শৈশবের জন্য মাতম’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘সবকিছু আজ ভুলতে পারি নদীর নাচন, নোংরা বচন, প্রেমের পচন তুই সেখানে মাতম নগর, কিশোর শহর—ভুলতে পারি?’

কবিতার উদ্ধৃতাংশে ‘নদী’, ‘বাতাস’, ‘রাত’, ‘নক্ষত্র’, ‘জোছনা’, ‘পাতা’ ইত্যাদি প্রকৃতিজাত শব্দ রূপক হিসেবে কবিতায় স্থান পেয়েছে। কবির ‘হে মাটি পৃথিবীপুত্র’ কাব্যের ‘বীজের ভাষা’ কবিতা থেকে পাঠ নেওয়া যাক—

‘জলের কাছে ধার চেয়েছি স্রোত
স্রোতে আমার খড়কুটো যায় ভেসে
এক তমসা অনেক নদীর মুখে
বিষাদ এসে রৌদ্র তীরে মেশে’

কামাল চৌধুরীর কবিতায় জীবন ও জগতের সত্য অনুসন্ধান ও উপলব্ধি এবং সৌন্দর্যসৃষ্টির মূলে প্রকৃতির প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি বুঝেছেন, প্রকৃতিই হলো দর্শনচর্চার উপযুক্ত স্থান। উপমা-রূপক-প্রতীক নির্মাণের শ্রেষ্ঠ জায়গা, সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এ জন্য তার কবিতায় প্রকৃতি জিজ্ঞাসা জীবনের মূল স্রোত থেকেই উত্থিত জিজ্ঞাসার পরিপূরক বলা যায়।  
আবার কামাল চৌধুরীর কবিতার নিবিড় পাঠে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট যে সমকালীন টানাপোড়েন তাঁর কবিতায় তীব্র ভাবে উপস্থিত। তা হোক সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক যে কোনও বিষয়। তার কবিতায় সনাতন ধারার রোমান্টিক চেতনার পাশাপাশি মানবীয় আবেগ, দুঃখবোধ, ব্যক্তিক বৈরাগ্য ইত্যাদি অবলোকন করা যায়। তার প্রতিবাদমুখর পঙক্তি সময়কে ধারণ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও তা প্রকৃতির নিবিড়তা জারিত। অর্থাৎ তিনি কখনো প্রকৃতিবিমুখ হননি। আসলে প্রকৃতি এমন এক কল্পরাজ্য, যেখানে সুখ-শান্তি-স্বস্তি, নাগরিক গ্লানি থেকে মুক্তির যাবতীয় রসদ বিদ্যমান। একজন সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে তাই এই মহাআশ্রয় ত্যাগ করা সম্ভব হতে পারে না। তাঁর কবিতায় ব্যক্তিক ভাবানুষঙ্গ, আত্মানুভবরাশির যে উপস্থিতি তা প্রকৃতির মোড়কে। কয়েকটি পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে—

ক. বৈশাখ আসুক ফের ফেরিঘাটে আমাদের যোগাযোগ হবে
খ. বোনের আঁচল থেকে ধ্রুবতারা খসে খসে আলো জ্বেলে যাবে
গ. আমি আড়ি পেতে শুনে ফেলি শালিকের চুম্বনের শব্দ
ঘ. প্রতিদিন একটি আকাশ নেমে যাচ্ছে দূর ধান ক্ষেতে
ঙ. হেভি মেটালের শব্দে মৃত রবীন্দ্রনাথের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে আমাদের সব নদী
চ. মরে গেলে মানুষেরা হাড়/ হাড় থেকে তীব্র তাজা ফুল/ এই দেশে অনেক বকুল

বলার অপেক্ষা রাখে না যে চিন্তার জগতে কবিমাত্রই স্বতন্ত্র। চিন্তার দার্ঢ্য, যুক্তির শৃঙ্খলা আর অভিজ্ঞতার নির্যাস ঢেলে সমকালের সঙ্গে মহাকালের রসায়নে সমর্থ কবির হাতেই জন্ম হয় মহাকালের কবিতা। আর যে কবিতা মহাকালের স্মারক, সে কবিতায় শুদ্ধ পাঠকের পরিভ্রমণ শেষ হয় না। আবার এও সত্য যে একটি শতাব্দিতে শত শত কবির আবির্ভাব ঘটে। এদের সবাই কবি হয়ে ওঠেন কিংবা কালের বিচারে উতরে যান তেমনটিও নয়। যারা দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন, শুধু তারাই শামিল হন মহাকালের স্রোতে। কল্পনাশক্তির প্রখরতার কারণে বিভিন্ন কালপর্বের কবিরা পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যেও চিহ্নিত হন। এদের মধ্যে যারা স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম, পাঠক তাদের মনে রাখেন। যুগ পরিক্রমায় পাঠকও প্রাগ্রসর, বিধায় পাঠকের মেজাজ ও রুচির সঙ্গে যে কবি প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার মিথষ্ক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হন; মহাকাল তাকে ভোলে না। কামাল চৌধুরীর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে কবি ও কবিতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো মননে ঘনীভূত হয়। গভীর পাঠে কামাল চৌধুরীর কবিতা পাঠকের মননে মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। কেননা, তিনি যেমন রোমান্টিক, তেমনি আধুনিক। তবে তিনি শুধু কল্পরাজ্যের বাসিন্দা নন। তিনি রোমাণ্টিকতার আদলে এবং প্রকৃতিলগ্ন শব্দরাশিকে রূপকে রূপান্তরের মাধ্যমে জীবনের সত্য তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। যে সত্য প্রতিনিয়ত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কবির কবিতা থেকেই পাঠ নেওয়া যেতে পারে—
পরিশেষে বলা যায়, প্রকৃতির ভেতরই যেমন মানুষের শেকড় প্রোথিত। তেমনি আবহমান জীবন, মানুষের কর্মক্ষেত্র, ঋতুচক্রের আবর্তনে মানুষের মনের রূপবদল ইত্যাদি নানাবিধ অনুষঙ্গ কামাল চৌধুরীর কবিতায় সসম্ভ্রমে উঠে এসেছে। তিনি শুধু দৃষ্টিনন্দনের ক্ষেত্র হিসেবে প্রকৃতিকে অবলোকন না করে নগরজীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির গন্তব্য এঁকেছেন আবার প্রকৃতিলগ্ন মানুষের মিলিত রূপেরও প্রত্যাশা করেছেন। কবির প্রকৃতি-বিমুগ্ধতা বিদগ্ধ পাঠকের চৈতন্যে নতুন দৃশ্যকল্প সৃষ্টির পাশাপাশি নান্দনিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। কবিতায় প্রকৃতি ও প্রকৃতিজাত শব্দের রসায়নের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় কবিকে প্রকৃতি-রোমান্টিক কবিও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

তথ্য সহায়তা
১.  হে মাটি পৃথিবীপুত্র (২০০৬) ও কবিতা সমগ্র (২০১১) কামাল চৌধুরী।
২.  প্রবন্ধ: কবি কামাল চৌধুরী ভাস্বর স্বকীয় নির্মিতি, মো. কাবির-উল হাসান, দৈনিক জনকণ্ঠ,  
     ঢাকা, ২৩ আগস্ট ২০১৩।
৩.  আধুনিক বাংলা কাব্যপাঠের ভূমিকা, কাবেদুল ইসলাম, জয়তী, ঢাকা; এপ্রিল ২০১১।
৪.  টলস্টয় বিষ্ণু দে ও অন্যান্য, হেলাল আহমেদ, বাংলা একাডেমি, জুন-১৯৯৯।
৫.  প্রবন্ধ: কামাল চৌধুরীর কবিতা : শুভবাদী রোদজোছনার মিছিল, আমিনুল ইসলাম
     ভোরের কাগজ, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫।