‘সার্বিয়া : শুভ্র শহরের দেশে’ বর্ণিল স্বাদের ভ্রমণ গদ্য

Looks like you've blocked notifications!

‘বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশিরবিন্দু।’

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় এটা স্পষ্ট যে, বহু ক্রোশ দূরের দেশে ঘোরাঘুরি একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার। এজন্য বিপুল অংকের না হলেও মোটামুটি অর্থকড়ি থাকা আবশ্যক। আধুনিক সময়ে দেশের বাইরে যেতে ভিসা, পাসপোর্ট, বিমানভাড়া, হোটেল, পরিবহণ, খাওয়া দাওয়াসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বলাইবাহুল্য চোখ কপালে তোলার মত। অজানা জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সাধ থাকলেও অনেকেরই সাধ্যে তা কুলায় না। তবে, ভিসা, পাসপোর্ট ছাড়াই ঘোরাঘুরির সাধ মেটাতে পারে ভ্রমণসাহিত্য। পর্যটকের বেশে থাকা লেখকের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার অনুপম বর্ণনায় পাঠক পেতে পারেন কোনো দেশ, ঐতিহাসিক বা দর্শনীয় এলাকা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতির পরিচয়সহ অচেনা-অজানা অধ্যায় সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা, যা তাকে ভ্রমণের স্বাদে সমৃদ্ধ করবে, অনেকটাই মেটাবে ভ্রমণ ক্ষুধা। এখানেই পাঠকমহলে ভ্রমণসাহিত্যের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা।

বিশ্বখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা  যেমন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখেছেন, তেমনি খ্যাতিমান প্রায় সব লেখকই লিখেছেন ভ্রমণকাহিনী। পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যেই ভ্রমণ গদ্য বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছে। একজন লেখক উপন্যাসিক, কবি, গল্পকার সাহিত্যের যে ধারায়ই অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেই লিখেছেন তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। বাংলা সাহিত্যও যার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অন্নদা শংকর রায়, মুজতবা আলী থেকে হাল আমলের সুনীল-সমরেশ, কিংবা বুলবুল সারওয়ার, মঈনুস সুলতান-ফারুক মঈনুদ্দীন বাংলা ভ্রমণ পাঠকদেও বর্ণিল ভ্রমণ স্বাদ জুগিয়েছেন। এই তালিকায় জানা-অজানা আরও অসংখ্য লেখকেরও নাম বলা যায়, যাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা মলাটবদ্ধ হয়ে পাঠককে অজানা অচেনা দেশ, দেশের মানুষ, তাদের সমাজ-সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাংবাদিক ও লেখক ইমদাদ হকের ‘সার্বিয়া : শুভ্র শহরের দেশে’ বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের পাঠককে আন্দোলিত করার মতো তেমনি একটি গ্রন্থ। 

প্রচলিত ধারায় বেশিরভাগ ভ্রমণকাহিনী ধারা বিবরণী টাইপের হয়ে থাকে। লেখক কোথা থেকে কোথায় গেলেন, কী দেখলেন, কী খেলেন—এর বর্ণনা দেন। বাড়ির পাশে আরশিনগর ও প্যারিস এয়ারপোর্ট অধ্যায় দিয়ে লেখকের সার্বিয়া ভ্রমণ শুরু (পড়ুন পাঠকেরও)। দুটি অধ্যায়েই পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, শুধু লেখকের এখানে গেলাম, এটা দেখলাম আর ওটা খেলামে বইটি সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটা অধ্যায়েই লেখক প্রাসঙ্গিক তথ্য, ইতিহাস কিংবা বর্ণিল সংস্কৃতির ঝাঁপি পাঠকের দুচোখের সামনে এনে হাজির করেছেন। বাদ যায়নি সার্বিয়ান দেশ ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সংস্কৃতি, ফ্যাশন, দেশটির পরতে পরতে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকা মার্শাল টিটো ও তার স্ত্রী সাবেক ফার্স্ট লেডি জোভাঙ্কা ব্রোজের পরিচিতি, প্রভাব ও ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রদর্শনী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার হাল, ভৌগলিক পরিচয়, খেলার জগতে দেশটির অবস্থা, বিশেষ করে ফুটবলের তুমুল জনপ্রিয়তা, পার্কসহ দর্শনীয় স্থান, ঐতিহ্য ধরে রাখা রাজ পরিবারের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও গুরুত্ব, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও প্রশাসনিক স্থাপনা, দানিউব ও সাভার তীরের রোমান্টিসিজম। ইলন মাস্কের বিশ্বব্যাপী সাড়াজাগানো কোম্পানি টেসলা, যার নামানুসারে সেই বিখ্যাত সার্বিয়ান উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলাকে নিয়ে রয়েছে স্বতন্ত্র অধ্যায়। এককথায় ১৭৬ পৃষ্টার এই বইয়ে বলতে গেলে বাদ যায়নি কিছুই। 

ভ্রমণবিষয়ক এই বইটি পড়তে গিয়ে কখনও কখনও উপন্যাস বলেও মনে হতে পারে। কারণ লেখকের সাথে ক্রিভো নামে সার্বিয়ান তরুণীর দুষ্টুমিষ্টি আলাপ, হেঁয়ালির সঙ্গে অজানাকে জানার বা দেখার কৌতুহল মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই বলা যায়, পাঠকের বোরিং হওয়ার সুযোগ নেই। লেখকের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় পাঠকও একাকার হয়েছে আরেকটি কারণে। প্রাঞ্জল বর্ণনার সঙ্গে পুরো বইটিই রঙ্গিন এবং প্রাসঙ্গিক ছবিতে ঠাসা। 

ইবনে বতুতার রিহলা যেমন বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা জানার আকর গ্রন্থ হিসাবে যুগে যুগে পাঠকমহলের নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র হিসাবে বিবেচিত হয়, তেমনি ইমদাদ হকের সার্বিয়া : শুভ্র শহরের দেশে ভ্রমণগ্রন্থটিও অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সার্বিয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্য প্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত বইটির মলাট মূল্য ৬০০ টাকা।