স্মৃতিতে শঙ্খ ঘোষ
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি ও সাহিত্য সমালোচক শঙ্খ ঘোষ। মানুষ কতটা বিনয়ী হতে পারেন, আমার চোখে দেখা সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। বরেণ্য এ সাহিত্যিকের যেটুকু সান্নিধ্য পেয়েছি, পুরো সময়টুকু মনে আজীবন গেঁথে থাকবে। শুধু গেঁথে থাকা নয়, তাঁর এ দৃষ্টান্ত আমার জীবন চলার পাথেয় হয়ে থাকবে।
২০১৯ সালের ৪ মে, পড়ন্ত বিকেল। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস। উড়িষ্যায় হানা দিচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ফণী। কলকাতায় যে তাপমাত্রা থাকার কথা, তেমনটি অনুভূত হচ্ছে না। কলকাতা শহরের মির্জা গালিব স্ট্রিটে ট্যাক্সি ভাড়া নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। গন্তব্য কলকাতার উল্টোডাঙা ভিআইপি মোড়ের ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস। সেখানে চিন্তাশীল মানুষ থাকেন। বিশুদ্ধ চিত্তের কবি থাকেন। অর্থাৎ কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করব ভেবেই এ অপেক্ষা। কবি সন্ধ্যার পর সময় দিয়েছেন। কিন্তু ট্যাক্সি পেতে পেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমার মন খারাপ হতে শুরু করল। যদি দেরি হয়ে যায়। তবে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ না মেলায় এ দুঃখবোধ বাড়তেই থাকে। যদিও সফরসঙ্গী বন্ধুবর কবি মুহাম্মদ ফরিদ হাসান একবিন্দুও হতাশ হলো না। তাঁর সাথে পূর্বযোগাযোগ ফরিদ হাসানই করেছিল। এক ঘণ্টা চেষ্টার পর ৬টা ৪ মিনিটে ট্যাক্সি পেলাম। ট্যাক্সি ধরে চলতে চলতে যতগুলো বইয়ের দোকান পেলাম, প্রায় সবকটি দোকানেই কবি শঙ্খ ঘোষের বই খুঁজলাম। পেলাম না। বিশেষ করে কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকায় কোনো বইয়ের দোকানে তাঁর কোনো বই পাওয়া গেল না। অথচ তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। শুধু তাঁর নয়, এখানে কোনো বাংলা লেখকের বই নেই। ব্যবসায়ী চিন্তা থেকে শুধু ইংরেজি বই রেখেছেন বই দোকান-মালিকেরা।
ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম এ ওয়ান বাই সিক্স ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস। এত সরল হবে গন্তব্যে পৌঁছা, ভাবতে পারিনি। শঙ্খ ঘোষের বাড়িটি খুঁজে পেতে কিছু সময় ব্যয় হবে, তা আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু উবারের প্রাইভেট কার থেকে নেমেই পেয়ে গেলাম ভিআইপি মোড়। পাশেই যে এলাকা পেলাম, গেইটে প্রবেশ করতেই দারোয়ান বললেন, কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ি যাবেন তো? আমরা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ি। আমাদের মুখ দেখে আন্দাজ করে কত দ্রুত গন্তব্য বলে দিলেন লোকটি। অবাক না হয়ে উপায় কী? ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের তিন তলায় থাকেন কবি।
তিনি সন্ধ্যার পর সময় দিয়েছেন; খুব বেশি দেরি হয়ে গেলো কি না, এমন শঙ্কায় সিঁড়ির ধাপগুলোয় পা ফেলছি। তিনতলায় ডানপাশের ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপলাম। মিনিটের মধ্যে একজন এসে দরজা খুলে দিলেন। কবি শব্দ উচ্চারণের আগেই জি জি আসুন। ভেতরে আসুন বলে অন্দরে চলে গেলেন তিনি।
কবির লেখার কক্ষে সোফায় বসে অপেক্ষা করছি। বেঁতের সোফা। একটা টি টেবিল। একপাশে কবির বসার চেয়ার। সিঙ্গেল একটা চৌকি। ব্যস। চারদিকে আর যা কিছু ছিল শুধু বই আর বই। ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বুকসেলফ চোখ বোলানো শেষ না হতেই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে কবি হাতের লাঠিতে ভর করে খুব ধীর পায়ে হেঁটে আসছেন। আমি ও ফরিদ হাসান দাঁড়িয়ে এগিয়ে প্রণাম জানাই। কবি কী বললেন বুঝতে পারলাম না। মুচকি হাসি দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, আমরা তাঁর যেন কত পরিচিত ও আপনজন। তৃতীয় কোনো লোক থাকলে ধরতেই পারতেন না, এটি ছিল তাঁর সাথে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। কবি কথার স্বর বড় করতে পারেন না। কিন্তু মন আর মুখের গতিপথ বলে দেয়, মানুষকে বরণ করতে ফুলের তোড়া, ডালা বা গালিচা লাগে না। চোখের সহজ স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট।
এ ক্ষুদ্র জীবনে অনেক সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়েছে। সবাই দু-চার মিনিট সময় দিয়েই বিদায় জানিয়েছেন কৌশলে। এমনও হয়েছে অনেকের সাথে দু-চারটের বেশি কথা বলাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অথচ অপেক্ষা করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দু-চার শব্দ বাক্যবিনিময় করে হাতটা প্রসারিত করে করমর্দন সারেন। অর্থাৎ আপনি আসতে পারেন। কেউ বা উঠে দাঁড়ান, মানে অনেক কাজ পড়ে আছে... আপনি আসলে... আমি কাজে যেতে পারি। যদিও ব্যস্ততা মানুষকে রোবট বানিয়ে রেখেছে।
মনে এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়েই কথা হচ্ছিল কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে। দশ মিনিটের মধ্যে কলকাতার স্থানীয় আরও দুজন নাটক ও সাংবাদিক জগতের মানুষ এলেন। আমরা না চিনলেও তাঁরাও যে এ জগতের বড় মানুষ, বুঝে নেওয়ার যুক্তিসঙ্গত বেশ কিছু ইঙ্গিত বহন করেছিলেন।
যা হোক, ফরিদ হাসান কিছু কাজের কথা সেরে নিল। এর ফাঁকে টি-টেবিলে নাশতা চলে আসে। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পেটে একফোঁটা খাওয়ার আগ্রহ ছিল না। মূলত, মানুষ যখন খুব খুশি হয়, খিদে তখন গোপনে লুকায়। ফরিদ হাসানকে ইশারায় বললাম, আমাদের ওঠা উচিত। ফরিদ বুঝতে পেরে বিদায় নিতে চাইলে, নাশতা না খেয়ে উঠতে বারণ করলেন কবি। নাশতা খেতে খেতে কথা বলছিলেন অন্য দুই অতিথির সঙ্গে।
বিবিধ কথায় প্রায় এক ঘণ্টা। আমি পুনরায় ফরিদ হাসানকে ইঙ্গিত করলাম। এবার বিদায় নেয়ার অনুমতি মিলল। আমাদের বিদায় জানাতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর দাঁড়ানোতে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল কয়েক গুণ। চিন্তার জগতে এত সমৃদ্ধ মানুষ, তিনি সময় দিয়েছেন, এটাই তো বড় কথা। আমি মুগ্ধ হতে হতে বিস্মিত হলাম। উনি দাঁড়াবেন, যা ছিল কল্পনাতীত। কারণ, তিনি মূলত দাঁড়াতে প্রায় অক্ষম। কিন্তু বিপত্তি ঘটল আরও। তিনি হাতের লাঠি ভর করে আমাদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন।
আমরা দুজন বারবার বললাম, আপনি বসুন। আসতে হবে না। তিনি তা মানলেন না। মূল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। প্রণাম জানিয়ে শেষ বারের জন্যে বিদায় নিয়ে তাঁকে ভেতরে রেখে দরজা টেনে দিতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। তিনি দরজা খুলে বাইরে আসছেন, আমরা তখন সিঁড়ি ধরে নিচে নামছি। তিনি হাসিমুখে জড়সড় শরীরে এবার বিদায় জানালেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ভাবলাম, মানুষ এতটা বিনয়ী হতে পারে কীভাবে? হয়তো বিনয়ী হতে, অর্থ-বিত্ত, বয়স-বার্ধক্য কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। শুধু একটি বিশুদ্ধ চিত্তের প্রয়োজন। ২১ এপ্রিল কবি চলে গেলেন। কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ওপারে ভালো থাকুন কবি।