উপন্যাস কিস্তি ৩৩

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

Looks like you've blocked notifications!

জুলেখার মায়ে সগল কথা কইতে গিয়া কোনো সোম ঝুপঝুপাইয়া কান্দে। কোনো সোম ফোঁপায়। কোনো সোম শুকনা খরখার চক্ষে মাটির দিগে চাইয়া থাকে, আর জুলেখার বাপের বিত্তান্ত-সকল কইয়া যায়। অদিগে দেখো, বিত্তান্ত শোনতে শোনতে ইসুফ মিয়ার মায়ে পরথমে ঠাসকি খায়। তারবাদে ঘটনা সগল শোনতে শোনতে তামান শইলটা তার হুনহুনা ঠাণ্ডা, ভারী পাত্থর হইয়া যাইতে থাকে ক্রমে ক্রমে।

ক্রমে তার মোনে অইতে থাকে য্যান সেয় আর জ্যাতা নাই। সেয় য্যান একটা মরা গজার মাছ! ভোমলা খাইয়া পইড়া রইছে য্যান সেয় নিঃসাড় পানিতে! শইল্লে কোনো জোর পায় না ইসুফ মিয়ার মায়ে! একটাবারের লেইগা ঠোঁট দুইখান এট্টু লাড়ে, সেই তাগদটুকও পায় না সেয়! বাইরে শইল্লের এই তবদা-খাওয়া দশা; কিন্তু তার পরানের ভিতরে দেখো কত কথার লড়াচড়ি চলতাছে! তার পরানখান দেখ কাটা মুরগির লাহান দাপড়াইতাছে! খোদা!

মাইয়া মাইনষের কপালে এমুনই তো লেখছে বিধি! এই লীলায়ই তো চইল্লা আইতাছে যুগ-জনম ভইরা! এটি নতুন কিছু না তো! আউজকা এই দিগ দিয়া তার জিন্দিড়ির পাড় ভাঙতাছে, আউলকা আরেক দিগে দেখ তার চর ওঠতাছে! তয়, এই জুলেখার মা পোড়া-কপালির জিন্দিগিতে চর আর কবে ওটবো! এরে তো বিধিয়ে খালি ভাঙ্গোন-খাওনের নসিব দিয়া থুইছে!

আহ! কেমনে নিজের পুরা জিন্দিগি দিয়া বানাইন্না- আপনা সংসারখান- আরেক জোনের হাতে তুইল্লা দিব জুলেখার মায়! দিয়া, কেমনে উয়ে নিজের সংসারেই দাসি-বান্দির লাহান দিন পার করব! কেমনে দিন যাইব অর! কোনো আশাখান আর পরানে নিয়া বাইচ্চা থাকব উয়ে!

কিন্তুক, জুলেখার বাপেরেই বা কেমনে দোষ দেওন যায়! না, তারেও দুষতে পারতাছে না ইসুফ মিয়ার মায়ে! সেয় পুরুষপোলা! খাওয়াইতে পারলে, পালতে পারলে দুই বিয়া সেয় করতেই পারে! শরীয়ত মাইন্না, হক-হালালি কামই তো করতে চাইতাছে বেটায়!

আর, অই বেটায় তো কোনো অনিয্যি কথাও কইতাছে না। তার তো নিজ ফরজন্দ-আওলাদ পাওনের হক আছে! আঁটকুড়া হইয়া মরলে তার সয়-সম্পত্তি খাইব কেটায়, দুনিয়ায় তার নাম জিয়াইয়াই বা রাখব কেটায়! তার নয়া বিয়ারে ঠেকানের হকও তো দুনিয়ার কেউর নাই!

সগল বিষয় লাইড়া-চাইড়া, ইসুফ মিয়ার মায়ে জুলেখার বাপের নয়া বিয়া করার বাঞ্ছাখানরে কোনোপ্রকারেই নিন্দা করতে পারে না। কিন্তু তাও ক্যান জানি ইসুফ মিয়ার মায়ের অন্তর মাটিতে-পড়া কৈ মাছের লাহান দাপাইতে থাকে, বেদম দাপাইতে থাকে।

ভিতরে তার অন্তর থাকে এই হালে, কিন্তুক বাইরে ইসুফ মিয়ার মায়ে না পায় সেই দাপানিরে বেক্ত করোনের কোনো শক্তি; না পায় জুলেখার মায়ের কাছে জুলেখার বাপের কামখানেরে বেক্ষান দেওনের কোনো জোর! একটা ঠাটা-পড়া তালগাছের লাহান পোড়া-মরা, কালা-আংড়া হিম, তবদা-খাওয়া হইয়া বওয়া দিয়া থাকে ইসুফ মিয়ার মায়ে। পুরা বাক্যিহারা হইয়া সেয় বওয়া দিয়া থাকে জুলেখার মায়ের সামনে।

না না! জুলেখার মায়ের এই এমুন নিদানের কালে, তারে দেওনের মতন কোনো নিদান-বিদ্যা জানা নাই ইসুফ মিয়ার মায়ের! তারে সাখোস দেওনের, ভরসার কথা কওনের খ্যামতা- বিধিয়ে দেয় নাই ইসুফ মিয়ার মায়রে! অর কপালে বিধি যা ল্যাখছে, সেই লিখন খণ্ডানির সাধ্যি কোনো মাইনষের নাই! যেই দয়াল-বিধি অরে দুনিয়ায় পাঠাইছে, সেয়ই দেখব অরে! অর বিমারের দাওয়াই কোনো মাইনষে দিতে পারব না! অখন, আল্লায় যা করে!

মনে মনে জুলেখার মায়রে আল্লার হাতে সইপ্পা দিয়া বাড়ির দিগে মেলা দেয় ইসুফ মিয়ার মায়ে। কোনো রকমে জুলেখাগো উঠানখান পার হইয়া সেই বাড়ির ঢাল দিয়া নামতে নামতে সেয় শোনে, কারা জানি ডাক পাড়তাছে! ডাক পাড়ে কেটায়!

ডাকটা আঁতকা শোনে বইল্লা পরথমে সেয় ধোক্কা খাইয়া যায়। ধরতে পারে না যে, কেটায় কারে ডাক পাড়তাছে! তারবাদে খেয়াল দিয়া শোনতে গিয়া সেয় তাজ্জুব হয়! ওম্মা গো মা! দেখ কারা ডাক পাড়তাছে! ডাক পাড়তাছে বাইদ্যানিরা!

‘বিষ বাত সারাই! শিঙ্গা লাগাই! বদ রক্ত ফালাই! মাজার বিষ, আটুর বিষ নামাই! লাগব নি গো!’

কী কারবার! এইবার বাইদ্যানিরা দেহি জষ্টি মাসেই আইয়া হাজির!

আর দেখ, অগো গলার হাল! গলার তেনে এটি কথা বাইর হইতাছে! লাগতাছে য্যান চিলেরা চিক্কুর দিতাছে! পুরা দেওভোগ গেরাম ছনছনাইতাছে সেই ডাক-চিল্লানির আওয়াজে!

যাউক! অগো কাম অরা করুক, ইসুফ মিয়ার মায় যাউক তার নিজ পথে। এই ভাবনা নিয়া সেয় আগ্গানি ধরে। তারবাদে দুই-চাইর কদম দিয়াও সারে নাই; সেয় শোনে যে, কেটায় জানি তরাতরি পাওয়ে তার পিছে পিছে নামতাছে। কেটায় আহে! জুলেখাগো বাড়ির তেনে আবার কে আহে! বিষয়টা দেখনের লেইগা মাথাটা এট্টু পিছে ফিরানের ফাঁকটাও পায় না ইসুফ মিয়ার মায়ে, সেয় দেখে তার লগে আইয়া খাড়াইছে জুলেখার মায়।

‘কি গো, জুলির মা? তুই আইলি এইনে কোন কামে?’ সেয় জিগায়।

‘ভাউজ, বাইদ্যানিগো গলা পাইলাম!’ জুলেখার মায়ে তারে জিগায়।

‘হ! আমিও তো পাইছি! তয়, বাইদ্যানিগো দিয়া তুই কী করবি?’

‘মাতাটা কয়দিন ধইরা টিপটিপাইয়া বিষ করতাছে! যায় না। দেহি অগো কাছে কোনো দাওয়াই যুদি থাকে!’ জুলেখার মায়ে কয়।

‘দেখ আলা তগো বাড়ির ঘাটার দিগে অরা কুনসোম আহে! থাক তাইলে তুই!’ জুলেখার মায়েরে তাগো বাড়ির ঢালে বাইদ্যানিগো লেইগা খাড়া কইরা থুইয়া নিজ বাড়ির পথে হাঁটা দেয় ইসুফ মিয়ার মায়ে!

আষাঢ় মাসের পইল্লা শুক্কুরবার আইতে খালি আর দুইটা দিন বাকি! সেই দিন মঙ্গলবার। বিয়ান বেইলে দেওভোগ গেরামের মাইনষের কাছে আঁতকা খবর আহে যে, গেরামে গরদিশ নামছে। কী হইছে?

না, জুলেখার বাপের ভেদ বমি হইতাছে। লগে দাস্ত তো আছেই। সেই দাস্ত-ভেদ বমি কী যাহা-তাহা দাস্ত-ভেদবমিনি! মাবুদ মাবুদ! একটা দণ্ডের বিরাম নাই। দাস্ত নামতাছে একদিগে, ভেদবমি হইতাছে আরেক দিগে! মাবুদ মাবুদ!

লোকেরা যে যেমনে পারে লৌড়ানি দিয়া আইয়াও সারে না, তাগো চক্ষের সামনে জুলেখার বাপের দমখান বাইর হইয়া যায়! কেউ কোনো একটা টোটকা-কবিরাজী করনের ফুরসতটাও পায় না।

কেমনে কী হইলো! কিয়ের মিদে কী হইলো রে আল্লা! মাটিতে পইড়া দাপড়াইয়া বিলাপ পাড়তে থাকে জুলেখার মায়। হায় হায়! আমি অখন কই যামু গো মাবুদ! কারে থুইয়া কারে নিলা রে নিদয় বিধি! অখন আমার উপায় কী গো মাওলা! এই ছার-কপালিরে আর কত পোড়াইবা রে তুমি! হায়রে হায়! আল্লা!

আহহারে! দুক্ষিণীর কান্দনে গাছের পাতারা ইস্তক ঝইরা যাইতে চাইতে থাকে! তাইলে মাইনষের চক্ষের পানি কেমনে আটকা থাকে! সগলতের চক্ষের তেনে পানি নামতে থাকে অজোর ধারে!

ইইস! কী উপায় অইবো এই মাতারির! পুত নাই ক্ষেত নাই! মাইয়াটায় আছিল, সেয়ও নাই। এই যে তার আছিল শেষ সম্বলখান- মাতারির মাথার উপরের চাল, তার খসমরেও তো নিল গা এইবার আল্লায়! অখন মাবুদেই জানে- এই রাঁড়ি-বেওড়ার জিন্দিগি কেমনে পার হইবো!

কেমনে কী হইলো! এত্তবড় মুসিবত আইল কোন রাস্তা দিয়া!

বহুত দিন বাদে আউজকা বিয়ানে জুলেখার মায়ে দুগা খুদ ভাজছে। জুলেখার বাপে কয়দিন ধইরা বাড়িতেই বহা! বিয়ার দিন ঘনাইয়া আইতাছে দেইক্ষা- সেয় নিজে তদারকী কইরা বড় ঘরের পিঁড়া-পুড়া লেপাইতাছিল। নয়া বউ আইব। এট্টু তো সিজিল-মিছিল করন লাগে ঘর-দুয়ার। লেপাইতাছিল জুলেখার মায়েরে দিয়াই। এই কয়দিনে সবই হইয়া গেছে, অখন খালি বড়ঘরের সামনের পিড়াটুকে শেষ পোছ দেওন বাকি।

সেই কামে হাত দেওনের আগে জুলেখার মায়ে আউজকা তরাতরি চুলা ধরায়। ধরাইয়া এক খোলা খুদ ভাজে। ভাজা গরম খুদ কুলায় বিছাইয়া থুইয়া জলদি হাতে এট্টু নারিকেলও কোঁড়ায় সেয়। কয়টা দিন ধইরা তার অন্তর বেজেহানি হইয়া গেছে- নারিকেল-কোঁড়া দিয়া দুগা গরম গরম খুদ ভাজা খাওনের লেইগা!

তয়, কামের বাড়ি। বিয়া কাম, নাও কাম আর ঘর কাম- এই তিন কাম কোনো বাড়িতে জোড়াইলে সেই বাড়ির লোকের কী আর দিন-দুনিয়ারে খেয়ালে রাখনের হুঁশ থাকে! কোনো কালেই থাকে নাই। জুলেখার মায়েরও বেদম পেরেশানি দশা! কামের উপরে কাম! কামের য্যান আর শেষ নাই!

অদিগে দেখ, পোড়া পরানে কী জ্বালান জ্বালাইতে থাকে! দুগা খুদভাজা মুখে দেওনের লেইগা পরানটায় তড়পাইয়া শেষ হইতে থাকে। কিন্তুক হাত আর আজাইর পায় না সেয়। শেষ-কাটালে আউজকা ঘোমের তেনে উইট্টাই জুলেখার মায় সাব্যস্ত করে যে, ঘর লেপুনির কাম শুরু করনের আগে দুগা খুদ ভাজবোই ভাজবো সেয়। তয় যুদি কামখান করা হয় তার!

খুদ-ভাজা দিয়া নারিকেল-কোঁড়া খাওনের লেইগা পাগল আছিল জুলেখায়! উয়ে থাকতে মায় পারলে নিত্যি খোদার তিরিশটা দিন এই খাওন বানাইছে - বাপ আর তার মাইয়ার লেইগা। জুলেখায়ও গেছে, আর এই বাড়ির তেনে সগল হাউস-আল্লাদও গেছে।

 উয়ে নাই হইয়া যাওনের পরে আর একদিনও এই জিনিস বাড়িতে বানানি অয় নাই! আউজকা জুলেখার মায়ের হাত এই কাম করোনের তাগদ কেমনে পাইলো! সানকি ভরা ফিনফিনা খুদ- ভাজা আর তার উপরে বিছাইন্না খলবলা সাদা নারিকেল-কোঁড়ার দিগে চাইয়া জুলেখার বাপে বোলে জিগায় জুলেখার মায়েরে।

মাতারি আর জব দিবো কী, চক্ষের পানি মোছোন দিতে দিতে সেয় রান্ধন ঘরে আহে। আইয়া খালি নিজের খুদ-দুগা খাইয়া, এক ঢোক পানি কেবল মুখে দিছে জুলেখার মায়ে; অমনেই সেয় শোনে যে বড়ো ঘর তেনে জুলেখার বাপে চিক্কুর-ডুক্কুর দিয়া বাড়ি মাথায় করতাছে।

কী হইলো কী হইলো! হরদিশা হইয়া তার কাছে লৌড়ানি দিয়া আহে জুলেখার মায়।

কি? না, তার বোলে পেট মোছড়াইতাছে।

পেট মোছড়াইতাছে, তয় টাট্টিতে গেলেই তো হয়! যান না ক্যান? জুলেখার মায়ে বোলে জিগায়!

সেই কথার জব না দিয়া বেটায় কয়, আমারে ধর তুই জুলেখার মা! ধইরা টাট্টিত নে! চক্ষে খুয়া দেখতাছি য্যান আমি !

ইয়া মাবুদ পাক পরোবারদিগার! কী কয় জুলেখার বাপে! কেমুন সর্বনাইশ্যা কতা কয়! কিছুর মধ্যে কিছু না, চক্ষে বোলে খুয়া দেহে সেয়! ক্যান খুয়া দেহে!

বেতালা হইয়া জুলেখার মায় তরাতরি আইয়া তার খসমের একটা ডেনায় ধরে। ধইরা কোনোমতে তারে খালি দরজার বাইর করছে, অমনেই কলকলাইয়া দাস্ত নামা ধরে। আয় ছোবানাল্লা! দাস্ত কী সোজা-তোজা দাস্ত! শইল্লের ভিতরখানই য্যান গইল্লা-পইচ্চা দাস্ত হইয়া বাইর অওয়া ধরে!

তখন বিমারীরে আর টাট্টিতে নিয়া ফল কী! জুলেখার মায়ে তারে উঠানেই বহায়। বহাইয়াও সারে না, জুলেখার বাপে বোমি করোন শুরু করে। একে তো দাস্ত যাইতাছিলই, লগে জোড়লো বেধুম ভেদবমি!

আয় হায় রে! আল্লা! একলা হাতে জুলেখার মায়ে তখন কোনদিগে যায়! না সেয় বিমারী মানুষটার মুখেই পানি দেয়, না গেরামের দশ জোনরে একটা ডাক দেয়! দিশা বিশা হারাইয়া সেয় বিমারীর মুখে পানি দিতে দিতেই ডাক-চিক্কুর পাড়া শুরু করে।

বিমারীর অবস্থা য্যান বেগতিক দেহা যায়! ইয়া গাফুরুর রাহিম! কী করবো অখন জুলেখার মায়ে! আগো দেওভোগের বাপ-ভাইয়েরা গো! কে কোনখানে আছেন গো বাবাসগল! আহেন আপনেরা তরা কইরা! জুলেখার বাপের ভেদ-বোমি হইতাছে! ও বাবাসগল! কে কই আছেন গো!

গেরামের বাড়িগুলা সেই কোন আগের আমল তেনের ছাড়া ছাড়া বাড়ি। একটা আরেকটার তেনে চিরকাল ধইরাই ফারাকে ফারাকে। এক বাড়ির ডাক-চিক্কুর আরেক বাড়িতে যায়। তয়, যায় খোবই ফিকা, হালকা স্বরে। তার উপরে জুলেখাগো বাড়িখান হইলো দেওভোগ গেরামের উত্তর দিকের শেষ সীমানার বাড়ি। সগল বাড়ির পরে অনেকখানি পতিত জায়গা পার হইয়া তয় এই বাড়ির ভিটি।

সেই ভিটির তেনে জুলেখার মায়ে চিক্কুর পাড়তাছে। তার চিক্কুর হুইন্না যে গেরামের লোকে দৌড়ানি দিয়া আইবো, সেই আশা করে না জুলেখার মায়। কিন্তুক, তাও তার মনে হয় যে -একজোন কেউ যুদি শোনে! কোনো একজোনের কানে যুদি ডাকখান যায়!

এমনে এমনে বহুতখোন যায়। জুলেখার বাপে দেখো ক্রমে ত্যানা ত্যানা হইয়া যাইতে থাকে। তার দাস্ত ফিরায়ও বিরাম নাই, ভেদবোমি তো ঢোক্কে ঢোক্কে যাইতাছেই! অখন উপায়! সেয় তখন বিমারীরে একলা ফালাইয়া থুইয়ায়ই ভিটির নামায় যায়। গিয়া, গলা ফাইড়া দশজোনেরে ডাক-দোহাই দেওয়া ধরে জুলেখার মায়। অগো, ভালা মাইনষেরা গো! জুলেখার বাপের বিষম বিপদ! আহেন আপনেরা সগলতে!

আল্লার কী কুদরত! এইবার এই ডাক ঠিকইএকজোনের কানে গিয়া লাগে। সেয় কেটায়? আর কে! সেয় মংলার মায়।

জুলেখাগো বাড়ির এক মুড়ায় সেয় বোলে কবে দেখছিল- দুনিয়ার পাদরা-পাতা হইয়া রইছে! সেই পাদরা পাতার লগে চাইল-বাটা দিয়া ঝাল চাপটি বানানের বাসনা হইছে তার সেদিন বিয়ানে! সেই কারোনে তখন সেয় আইতাছিল কয়টা পাদরা পাতা নিতে! আল্লা-রছুল! দেখো কোন গজবের তলে পড়ছে এই বাড়ির মাইনষেরা!

মংলার মায়ে তুফান ছুট দিয়া গেরামের সগলজোনরে সংবাদখান দেয়। তার নানা ইমাম হুজুররে ডাক পাইড়া আনে! কিন্তু দশজোনে আইয়া আর কী করবো! তারা আইয়াও সারে না, আল্লার মাল আল্লায় লইয়া যায় গা।

দশজোনে আইয়া বাক্যিহারা হইয়া খাড়া দিয়া থাকে। হায় হায়! এইটা কেমুন মউত! এই ভোর-বিয়ানেও তো ফজরের নমাজ পইড়া আইছে জুলেখার বাপে! ইমাম হুজুরের তেনে নয়া বিয়ার লেইগা নতুন কইরা দোয়াও মাইঙ্গা আইছে সেয়।

 তার নসিবে এমুন আঁতকা মউত! ফরজন্দ ফরজন্দ কইরা কেমুন পাগলা হইয়া গেছিল মানুষটায়! দেখো, তার কিসমতে ফরজন্দ লেখা নাই! জোর কইরা নি কপালের লিখন কেউ খণ্ডাইতে পারে! আফসোস!

দুপোর হওনের আগেই জুলেখার বাপেরে মাটি-মঞ্জিল দিয়া গেরামের মাইনষেরা যে যার বাড়িতে যায় গা। তয়, দেওভোগের কোনো একটা মানুষেরে খোদার দুনিয়ার কেউ নাদান কইতে পারবো না! তাগো অন্তরে খোদার ডর আছে। বুঝ-বিবেকও তাগো কম না! আবার ভুল-চুক কিছু হইলে তারে ধরাইয়া দেওনের একজোন মুরুব্বিও তাগো লগে আছে! সেই কারোনে তাগো কোনো ভুল হইলেও, লগে লগে সেইটারে শুধরানি দিয়া ফালাইতে পারে তারা।

এই যে সগলতে মুর্দারে দাফন কইরা আইসা জুলেখার মায়ের কী বেবস্থা করোন যায়, সেইটা নিয়াই খালি উতলা হইতাছিল; তখন আরো একখান গুরুতর কামের কথা তাগো স্মরণ করাইয়া দেয় কেটায়? দেয় ইমাম হুজুরে!

 সগলতে যখন জুলেখার মায় একলা বাড়িত থাকবো কেমনে সেই চিন্তায় পেরেশান; সেইসোম ইমাম হুজুরের মাথায় অন্য ভাবনা। সেয় দেখে যে, আরো দরকারী একটা কাম অক্ষণ তক্ষণ না করলেই না!

হুজুরে তখন সবতেরে ডাক দিয়া কয়, ‘মিয়ারা হোনেন! জুলেখার মায় আমাগো ঘরের মানুষ! সেয় পানিত পড়ে নাই! তার ভাবনা পড়ে হইবো। কিন্তুক আগে এক্ষণ আমাগো সংবাদ পাঠান লাগবো জুলেখার বাপের নয়া সম্বন্ধের বাড়িতে! হেরা তো এই আপদের কিছুই জানে না! না-জাইন্না হেরা তো বিয়ার আঞ্জাম করতে থাকব নে! হেইটা আগে বন করোন লাগবো আমাগো!’

হুজুরের কথায় প্রতিটা জোনের মনে আহে যে, হাছাই তো! গুরুতর বিষয় তো এইখানই! আর, হেইটাইর দিগেই কি না তাগো খেয়াল যায় নাই! সগলে ইমাম হুজুরের তারিফ করতে করতে মানুষ বিছরাইতে থাকে। কারে পাঠান যায় সেই গেরামে! কে যাইতে পারে এতবড় সর্বনাশের খবরখান লইয়া, সেই বাড়ির মাইনষের কাছে!

ইমাম হুজুরের ক্যান জানি মোনে হয়, ইসুফ মিয়ারই উচিত এই বিষয়খান সাব্যস্ত করন! সেয় কয়. ‘কি রে বাজান ইসুফ মিয়া? কারে পাঠান্তি উচিত বইল্লা সাব্যস্ত কর তুমি?’

আউজকা বহুতদিন হয় ইসুফ মিয়ায় দিনদুনিয়ার কোনো সাতে-পাঁচে থাকে না! দুনিয়ার সগল কিছুর তেনে তার অন্তর উইট্টা গেছে! চলুক অখন খোদার দুনিয়া- যেমনে চলনের চলুক! ১০ জোনের সামনে আউজকা, অখন আবার, ইমাম হুজুরে তারে টানে ক্যান!

কথা কইতে ইসুফের মন সরে না, কিন্তুক মুরুব্বি মাইনষের লগে সেয় বেদ্দবিই বা করে কোনপ্রকারে! না পাইরা শেষে ইসুফে কয়, ‘আমার সাব্যস্তের কতা যুদি জিগান হুজুর; তাইলে কই যে, আমাগো কামলার কোনো একজোনরে পাঠান্তিই হইবো ভালা কাম!’

ক্যান ! ক্যান! পাড়ার ময়-মুরুব্বিগো কেউ যাইবো না ক্যান?

‘আরে! এমুন আঁতকা মরার সংবাদ পাইয়া সেই বাড়িতে চিক্কুর-ডুক্কুর পড়বো। তারবাদে কেউ কেউ গালি-গালাইজের তুফানও ছাড়বো! দুক্ষের ঠেলায় কোনো জোনে না আবার লাঠি লইয়া লৌড়ান্তিই দিয়া দেয়! গেরামের কোনোজোনের লগে এমুনটা করলে, হইবো নি সেয় অপমানি?’

‘তার লগে আরো বেপার আছে! এই জুলেখার বাপে নিজে একলাই নিজের নয়া বিয়ার সম্বন্ধ করছিল। সেই সম্বন্ধ করতে হেয় কি গেরামের কেউরে লগে নিছিল? বুড়া জুয়ান – কেউরেই সেয় তার লগে নেয় নাই! নিজেই নিজের সম্বন্ধ পাকা কইরা, দিন-খোনও ধায্যি করছে। আবার, সেই মাইয়াগো বাড়ির তেনেও কোনো একটা মাইনষে আইয়া পাড়ার কেউরে তালাশও করে নাই! তাইলে সেই সম্বন্ধের বাড়িতে গেরামের কোনো জোনে যাইবো কোন ঠেকায়? তাগো মান-ইজ্জত নাইক্কা?’

 এই সগল বিষয় মোনে কইরাই অখন ইসুফের মোনে হইতাছে, সেইনে গেরামের কেউর যাওনের কোনো ঠেকা নাই। গেলে যাইবো জুয়ান কামলা ছেড়াটায়। সেই ছেড়ায় এক লৌড়ে গিয়া সংবাদখান দিবো। দিয়া আর খাড়াইবো না। উড়াল দিয়া আইয়া পড়বো। এই কথাখানরে দশজোনের কাছে উচিত মোনে হয়, না হয় না?

সগলতেই বোঝে যে, আল্লার রহমতে ইসুফ মিয়ার বুঝ-বুদ্ধি কিছু কম না!

অখন, অই নাই-সম্বন্ধের বিষয়খান তো ভালামতোনই ফায়সালা করন গেলো,কিন্তুক জুলেখার মায়ের বিষয়খানের কী হইব!

তারে এমুন মউতা বাড়িত একলা ফালাইয়া থোওন মাইনষের কাম হইবো না! আবার, মউতা বাড়ি খালি থুইয়া আর কোনোখানে গিয়া যে সেয় থাকব, তারও কোনো উপায় নাই। মরা বাড়ি খালি ফালাইয়া থোওনের নিয়ম নাই। নিয়ম পালনি না করছো, তয় মরছো!

ইমাম হুজুরে কয়, তাইলে মংলার মায় অখন থিকা এই বাড়িতে থাকা ধরুক! তবে এই নিয়া জুলেখার মায় কোন কথা কয়, সেইটাও তো দশজোনরে শোনোন লাগে!

বড় ঘরের মাইজ্জালে লেট দিয়া বসা জুলেখার মায়ে কান্দতে কান্দতে কোনোমতে ইসুফের মায়ের কয়, ভাউজ! আপনেরা যা ভালা বোজেন, তার উপরে দিয়া আমি কী কমু!

তবে অন্তরে অন্তরে জুলেখার মায়ে বিরাট এক ডর আর ভাবনায় খাবিজাবি খাইতে থাকে। এই যে জুলেখার বাপে মরছে; অখন আমি আভাগীরই বা খোরাকির উপায় কী! আর মংলার মায়েরে পাতেই বা দিমু কী!

তয়, সেই কথা সেয় আর মোখ ফুইট্টা কয় না।

মউতা বাড়িত তো চাইর দিন চুলা জ্বলোন নিষেধ! এই চাইর দিনের বেবস্থা কী! ইমাম হুজুরে সর্ব জোনের সামনে কথাখান তুইল্লাও সারে না, লোকে হাইরে-মাইরে কইরা ওঠে!

এইটা একটা কতা কইলো হুজুরে! গেরামের সগলতের ঘরের তেনে খাওন আইবো এই বাইত!

‘ তয় একজোনের খাওন দিলে কিন্তুক হইব না!’ হুজুরে স্মরণ করাইয়া দেয়; ‘ মংলার মায়ও তো থাকতাছে এইনে!’

(চলবে)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩১)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩০)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৯)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৮)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৭)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৬)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন  (কিস্তি ১৩)​

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)​

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)​

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)