আমলকীর মৌ

স্বাধীনতাত্তোর নারীবাদী উপন্যাস

Looks like you've blocked notifications!

‘আমলকীর মৌ’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই লেখা একটি উপন্যাস। প্রকাশকাল ১৯৭৮। রাজনৈতিকভাবে চরম অস্থিরতার মধ্যে রচিত হলেও এটি কোনোভাবেই তথাকথিত রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেম কৌশলে ও সচেতনভাবেই ওই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে সামাজিক-পারিবারিক জীবনকে উপজীব্য করে তুলেছেন এই উপন্যাসে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে যারা নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন, কেবল তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দিলারা দেখিয়ে দিলেন, একটা যুদ্ধের মীমাংসা হতে এখনো বাকি যুদ্ধটা নারী-স্বাধীনতার যুদ্ধ কিংবা আরো পরিষ্কার করে বললে, মানবতার মুক্তির যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলো, নারী স্বাধীন হয়েছে কি? মুক্ত হতে পেরেছে কি সমাজের বোধ-বুদ্ধি? এমন সব প্রশ্ন নিয়েই যেন হাজির হলো ‘আমলকীর মৌ’।

দিলারা হাশেম একটা নব্য স্বাধীন দেশের স্বাধীন কিছু বায়বীয় চরিত্র নিয়ে দেখিয়ে দিলেন, পুরুষকেন্দ্রিক সভ্যতাসৃষ্ট এথিকস, ভ্যালুস, ল সর্বোপরি একটি আপাদমস্তক সমাজব্যবস্থা—তার হাতে যেমন নারীরা জিম্মি, জিম্মি তেমন পুরুষরাও।

আপাতদৃষ্টিতে এই উপন্যাসের মূল ইস্যু হলো জেন্ডার বিভাজন। তাই আলাদা করে উপন্যাসটিকে নারীবাদী উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আরো অনেক লেখা হয়েছে। তবে তসলিমা নাসরিনকে বাদ দিলে এ রকম সাহসী উপন্যাস দুটো লেখা হয়েছে কি না সন্দেহ। সত্তর দশকে মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী এক নারী, নাম সারা, স্বামী-সন্তান ছেড়ে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে বাস করছে। রাত নেই, দিন নেই রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। ইচ্ছে হলে পান করছে তরল কিংবা ধূম। ব্যাচেলর বন্ধুর ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ছে যখন তখন। এটা ভাবতেই অনেক মেয়ের গা শিউরে উঠবে। আবার কেউ কেউ মেয়েটিকে ‘চরিত্রহীন’ ভেবে বসবেন। কিন্তু সারা মোটেও তা নয়; বরং তিনি ভীষণ আত্মসচেতন, আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিমতী ও উচ্চশিক্ষিত।

মহিলা-বিদুষী তার ওপর রূপসী, এই যোগ ঘটেছে সারার ক্ষেত্রে। এবং এই যোগসাধনই তার কাল হয়েছে নিজের জন্য, অন্যের জন্যেও। নারীরা রূপসী হলে সমাজের আপত্তি থাকার কথা নয়; বরং খুশির বিষয় সেটি, রূপের সঙ্গে সঙ্গে নারী যদি আত্মসচেতন, স্বাধীনচেতা ও প্রতিবাদী স্বভাবের হয়, তাহলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘোর আপত্তি চলে আসে।

সারা তার যোগ্যতাবলে যোগ্য মানুষের মতো আচরণ করেছে। তৈরি সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছে। সম্পূর্ণ না পারলেও সমাজের কিছু মানুষকে অন্তত সে বোঝাতে পেরেছে, এভাবেও নারীরা বেঁচে থাকতে পারে। এবং এভাবেই বেঁচে থাকা উচিত।

সারা অস্তিত্বসচেতন নারী। সে প্রশ্ন করেছে সমস্ত বৈষম্য নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে মাস্টার্স এবং বিদেশ থেকে ডিগ্রি ফেরত। সে ইচ্ছে করলেই তার রূপের সঙ্গে সঙ্গে এই যোগ্যতাকে গুলিয়ে অন্য রকম একটা জীবন পেতে পারত; কিন্তু সে তা করেনি। রূপচর্চা ও স্টাইল নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। কারণ সে বুঝে গেছে, এটা তার অস্তিত্ববিরোধী, নারীদের আরো নারী করে তোলার কারসাজি। ‘উপকরণ হিসেবে সে কোনোমতেই ব্যবহৃত হবে না, এক্সপ্লয়টডও নয়।’ [পৃ.-১২, ‘আমলকীর মৌ’, মুক্তধারা, ১৯৭৮] এটা তার সচেতন ভাবনা।

সারা গোড়া থেকেই সংসারের ছোটখাটো অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। প্রশ্নগুলো হয়তো আমাদের অজানা নয়, কিন্তু সারা সেগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। প্রশ্ন থেকে রেহাই পান না সংসারে তার অতি প্রিয় বাবাও। ‘যে লোকটি দিনের বেলায় আম্মা মানুষটার সাথে প্রায় সম্পর্কবিহীন দিন কাটায়, সে রাতে কোন সম্পর্কের দাবিতে এবং কীভাবে অতগুলি সন্তানের পিতৃত্বের অধিকারী হয়!’ [পৃ.-২৩] সংসারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা যে কোথায়, তা সারার প্রশ্ন থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সারা তার মা-বাবার মধ্যকার অস্বচ্ছ দাম্পত্য সম্পর্কের ভেতর থেকে তাবৎ নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভেতর একটা অস্বচ্ছতা দেখতে পায়। সারা এই ঘোলাটে সম্পর্কটা ধরতে পারে বলে সে তার স্বামী-সন্তান ফেলে চলে আসতে পারে। তার এই সাহসটার পেছনে ইন্ধন জোগায় তার অর্থনৈতিক সাবলম্বিতা।

সারার এই স্বাধীন জীবন তাকে সমাজ ও পরিবারের কাছে ‘মোস্ট আন-ওয়ানটেড’ করে তোলে। আবার রাতের অন্ধকারে এই সমাজেই সবচেয়ে ‘ওয়ান্টেড’ হয়ে ওঠে সারা। ভণ্ড সমাজ তখন মাতাল হয়ে নারীর সুখ চায়। সারা উপলব্ধি করে, যে লোকগুলো তাদের পরিবারের নারীগুলোকে শক্ত করে আটকে রাখে, সেই লোকগুলোই অন্য নারীকে বাইরে বের করে আনার জন্য আনচান করে! সারা বাইরে থাকে বলে যে সমাজ তাকে বলে, ‘মেয়েটার লজ্জা বলে কি কিছু নেই?’ ও ‘তোমার মতো মেয়ের বাবা বলে পরিচয় দিতে আব্বার লজ্জা করবে’—এ জাতীয় কথা। সারা কারো সঙ্গে বিছানায় যেতে রাজি না হলে সেই সমাজই আবার সারাকে ‘কনজারভেটিভ’ আখ্যায়িত করে বলে, ‘ইউ ডোন্ট নিড টু স্লিপ উইথ এভরি আদার বয় ইউ মিট, বাট ইউ মে স্লিপ উইথ ওয়ান অর টু ইউ লাইক মোস্ট। কাম অন সারা, শরীর ছুঁলেই তোমার প্লেগ হয়ে যাচ্ছে না।’ এমনি করে প্রায় প্রতিদিনই ঘরে ফেরার পর সারাকে তীক্ষ্ণ বাক্যের সম্মুখীন হতে হয়। সারা কখনো প্রতিবাদ করে, কখনো করে না। সারার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ তাদের কথায় নিজের জীবনের ছক থেকে তিল পরিমাণ নড়চড় না হওয়া।

উপন্যাসটি চরিত্রায়ণ, বিস্তার, ভাষা ও উপমার ব্যবহার—সব দিক থেকেই একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হয়ে উঠেছে। প্রতিটি চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, তার বেশি জানার প্রয়োজন পড়ে না। তবে প্লট কোথাও কোথাও খানিকটা ঝুলে গেছে। সেটা হয়েছে ঘটনানির্ভর উপন্যাসকে চরিত্রনির্ভর করে তোলার কারণে। যৌগিক প্লট ও উপপ্লটে ৩৮০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে মোট বিয়াল্লিশটি অনুচ্ছেদ আছে। সব অনুচ্ছেদ আয়তনে সমান নয়। অনুচ্ছেদ বিন্যাসে দিলারা হাশেম চিরায়ত পথে হেঁটেছেন। একেকটা অনুচ্ছেদে একেকটা গল্প নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন। প্লট কোথাও শিথিল, কোথাও দৃঢ়। উপন্যাসের গঠনের দিক দিয়ে প্লটটি বৃত্তাকার। একটি মূল ঘটনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাবতীয় ঘটনার অবতারণা ঘটে। উপন্যাসের সেটিং বা পটভূমি হলো ঢাকা, সময় সত্তরের দশক।

সুখপাঠ্য এই উপন্যাস বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এখনো সমান প্রাসঙ্গিক। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এটি নিয়ে চমৎকার ডেইলিসোপ নির্মাণ করা যেতে পারে। গল্পের বিস্তার ও নাটকীয়া সে ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।