বিজয়া-মানিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে
আমরা সাধারণত ক্যামেরার সামনে থাকা মানুষগুলোকেই বেশি চিনি। ক্যামেরার পেছনে যাঁরা থাকেন, তাঁদের চিনি যৎসামান্য। আর এই পেছনের মানুষগুলোর সাফল্যের পেছনে যাঁরা থাকেন, তাঁদের আমরা চিনিই না। বিজয়া রায় সে রকমই একজন না চেনা বা কম চেনা মানুষ। কিন্তু বাংলা সিনেমায় তাঁর অবদান কম নয়। গত মঙ্গলবার, ২ জুন তিনি প্রায় নিঃশব্দেই বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে।
ভেবে দেখুন একটি সাদাকালো বাংলা ছবি হচ্ছে, যার শুটিং চলছে চার বছর ধরে। বাড়ির কর্তা বিদেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ভালো মাইনের কাজ করছেন, পদ-পদবিও ভালো। সেই থেকে ছুটি নিয়ে তিনি বানাচ্ছেন ছবি।
মধ্যবিত্ত যে কোনো গৃহিণীর জন্যই ব্যাপারটা আতঙ্কের। কিন্তু বিজয়া কিন্তু ঘাবড়াননি। বরং ওই চার বছর ধরে সাহস দিয়ে গেছেন। ওই সাহসটুকু না দিলে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটা হয়তো আর দেখতে হতো না। সত্যজিৎ রায় হয়তো প্রথম সিনেমাটা অর্ধসমাপ্ত রেখে আবার সেই বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরিতেই ফেরত যেতেন।
তা হয়নি, বাঙালির কপাল ভালো, বাংলা সিনেমারও সৌভাগ্য।
মানিক যখন সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠেননি তখন থেকেই বিজয়া তাঁর সঙ্গী। সবচেয়ে ভালো চেনেন তিনি সত্যজিৎকে। সম্পর্কে ছিলেন মামাতো ভাইবোন। প্রেম করেছেন টানা আট বছর। লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। পরে অবশ্য বুদ্ধি করে দুই পরিবারকে রাজি করাতে পেরেছিলেন তাঁরা।
আত্মজীবনী ‘মানিক এবং আমি’-তে বিজয়া রায় নিজেই এসব কথা লিখে গেছেন। বইটা বের করেছিল পেঙ্গুইন।
বিজয়া রায় লিখেছেন, ‘কিশোরীকাল থেকেই মানিকের সঙ্গে আমার সখ্য। প্রেমটা শুরু ১৯৪০-এর দিকে। একসঙ্গে অনেক গান শুনতাম আমরা। সেগুলো নিয়ে আলাপ করতাম। ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকই বেশি শোনা হতো আমাদের। আমাদের আগ্রহের জায়গাটা ছিল একই, সিনেমা আর গান।’
দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন পরিবার থেকে বাঁধা আসবে। কারণ বিজয়া ছিলেন বয়সে সত্যজিতের চেয়ে বড়। তার ওপর আবার মামাতো বোন। একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দুজনের কেউই বিয়ে করবেন না। যেভাবে চলছে জীবনটা সেভাবেই কেটে যাবে।
এরপর সিনেমায় অভিনয় করতে মুম্বাইয়ে চলে যান বিজয়া। আর সত্যজিৎ থেকে যান কলকাতায় বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজ নিয়ে।
এ সময় দুজন চুটিয়ে প্রেমপত্র লিখতেন। বিজয়ার সাথে দেখা করতে প্রায়ই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা থেকে মুম্বাই যেতেন সত্যজিৎ। ‘লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ’ রাখতে গিয়ে, বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিজেরাই পাল্টালেন। বুঝলেন সংসার না পাতলে আর হচ্ছে না।
বিয়েটা তাহলে প্রাথমিকভাবে পালিয়েই করতে হচ্ছে। বিজয়া তাঁর মাকে ব্যাপারটা জানালেন। কিন্তু পালিয়ে বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দিলেন না তিনি। মায়ের কথা শুনলেন বিজয়া কিন্তু কাজটা নিজেদের মতো করেই সেরে ফেললেন। ১৯৪৯ সালে বিজয়ার দিদির বাড়িতে বিয়ে হয় সত্যজিৎ আর বিজয়ার।
আয়োজন ছোটখাটো হলেও সে সময় নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা পৃথ্বিরাজ কাপুর ও তাঁর স্ত্রী।
বিজয়া লিখেছেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি মানিকের সঙ্গে আদৌ আমার বিয়ে সম্ভব। যখন ব্যাপারটা ঘটেই গেল, তখন আমরা দুজনেই সুখ এবং কষ্ট দুটোই অনুভব করছিলাম। কারণ বিয়ে করলেও বিষয়টা কাউকে জানাতে পারছি না, এমনকি একসঙ্গে থাকতেও পারছি না তখন আমরা।’
সত্যজিৎ আর বিজয়ার মিলনে এগিয়ে এলেন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু এবং ডাক্তার নশো বাবু। সত্যজিৎ তাঁকে সব জানিয়ে দিয়ে একটা ব্যবস্থা করতে বললেন। নশো বাবুর বুদ্ধিতেই শেষমেশ রাজি হলেন সত্যজিতের মা।
কারণ সত্যজিৎ মাকে গিয়ে বলেছিলেন, বিয়ে করলে বিজয়াকেই করবেন, নচেৎ চিরকুমার থাকবেন।
ছেলের জেদের কাছে মাকে হার মানতে হলো। ভাগ্নি বিজয়াকেই পুত্রবধূ হিসেবে বরণ করে নিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালেই আবার বাঙালি রীতিনীতি মেনে বিয়ে হয় বিজয়া আর সত্যজিতের।
বিজয়া লিখেছেন, ‘আমার খুশি যেন বাঁধ মানছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল মানিকের সাথে আমার কখনোই বিয়ে হওয়া সম্ভব না। ওর সাথেই কিনা আমার দুবার বিয়ে হয়ে গেল।’