সালভাদর দালি ও তাঁর চিত্রকর্ম

Looks like you've blocked notifications!

বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য চিত্রকলা শুধু ছবি আঁকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তা জন্ম দিয়েছিল নানা শিল্প-আন্দোলনেরও। এসব আন্দোলন ছবির সঙ্গে সঙ্গে কবিতা, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি নানা শিল্প-মাধ্যমকে প্রভাবিত করে। বিংশ শতাব্দীতে এমন সব প্রভাব বিস্তারকারী শিল্প-আন্দোলনের যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের একজন হলেন সালভাদর দালি। কাতালানের স্বপ্নভূমি আমৃত্যু আবিষ্ট করে রেখেছিল সুররিয়ালিস্ট শিল্পচূড়া মনি সালভাদর দালিকে।

১৯২২ সালে সান ফার্নান্দো ইনস্টিটিউট, মাদ্রিদে তিনি চারুকলা পড়ার জন্য ভর্তি হন। অবশ্য চিত্রকলায় হাতেখড়ি হয় আরো আগে। এখানে এসে ভাস্কর্য আর চিত্রকলায় দক্ষতা বাড়তে থাকে তাঁর। শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁর মতের মিল হতো খুবই কম। মাদ্রিদে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় গার্সিয়া লোরকা, বুনোয়েল প্রমুখের সঙ্গে। ১৯২৬ সালে প্রথমবারের মতো প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। সেখানে পরিচয় আরেক বিখ্যাত শিল্পী পিকাসোর সঙ্গে। এ ছাড়া তাঁর যোগাযোগ তৈরি হয় সমসাময়িক শিল্পী ও চিত্রপরিচালকের সঙ্গে। ১৯২৯ সালে ১১টি পেইন্টিং নিয়ে প্যারিসে প্রথমবারের মতো চিত্র প্রদর্শনী করেন দালি। আস্তে আস্তে তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে।

দালি একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, গ্রাফিকস ডিজাইনার। কিউবিজম, ফিউচারিজম ও মেটাফিজিক্যাল পেইন্টিংয়ের অনবিচ্ছিন্নতায় তিনি সৃষ্টি করেন এমন এক সুররিয়ালিস্টিক আবহ, শিল্পকলার ইতিহাসে যা বিস্ময়কর। দালি তাঁর শিল্পকলায় এমন এক জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন, যার প্রভাবে বিংশ শতাব্দীর চিত্রকলায় খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত।  ৩৭ বছর বয়সেই দালি তাঁর জীবদ্দশায় নিজের জীবনবৃত্তান্ত লিখে যান। বইটার নাম The Secret Life of Salvador Dalí।

‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ দালির সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এ ছবির প্রধান চরিত্র ঘড়ি। অনেকগুলো ঘড়ির অভিব্যক্তিতে যুক্তির অতীত এবং কালাতীত অবস্থাকেও ধরতে চেয়েছেন দালি। এখানে সময় বর্তমানে লুপ্ত কোনো প্রাণীর মতো। এখানে সময় ঝুলে পড়েছে কাপড়ের মতো। গলে পড়েছে মাখনের মতো। এখানে সময় দংশিত কালো পিঁপড়াদের সমষ্টিগত আক্রমণে। এখানে সময় সাগরবেলায়, সাগরে, সাগরপাড়ের পাহাড়ে, দূর আকাশে। এখানে সময় পায়ের কাছে এবং এখানে দৃষ্টির অজান্তে ধাবমানতা আছে। আরো আছে বিশাল পর্বতের নিচে ক্ষুদ্রতম অনুষঙ্গ। এ নাটক তো দালিতে থাকেই। এ ছবির সূচনা ডাইনিং টেবিলে।

ফ্রান্সের বিখ্যাত পনির ক্যামোবের। গ্রীষ্মের উষ্ণতায় পনির নরম হয়ে এসেছিল। সাদা গলিত পনিরের দিকে চেয়ে জগৎশ্রেষ্ঠ দূরাভিসারী (ভিশনারি) দালির মনে হলো সময় এভাবেই চলছে, গলে পড়ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্রমে গলিত পনিরের জায়গায় উপস্থিত হলো ঘড়িগুলো। সময়ের অস্থিরতা স্মারক ঘড়িগুলোর কোনোটাই সদর্থকতার ইঙ্গিত দেয় না।

ঘড়ির যে গোলাকার ডায়াল সময়ের ঘূর্ণমানতাকে প্রকাশ করে, সেই বৃত্তের বেড়ি ভেঙে পড়েছে এ ছবিতে। যেখানে বৃত্ত রয়েছে, সেখানেও পিপীলিকার দংশনে সব সংখ্যা মুছে গেছে আর দংশনে ঘড়ির দেহ হয়েছে রক্তাক্ত। আরেকটি ঘড়িতে মাছি বসেছে। সেই ঘড়ির ভেতরকার নীল জল পান করছে মাছি। সময়ের এক অনন্য বয়ান দালির এই ছবি।

দ্য গ্রেট মাসটারবেটর ১৯২৯ : এটা দালির একটা শেলফ পোর্ট্রেট। সঙ্গমের প্রতি তাঁর চূড়ান্ত ভয় এবং বিতৃষ্ণাকে ফুটিয়ে তুলেছেন এই ছবিতে। এখানে ভূমির দিকে তাক করা পাথরের অবয়বটাই দালির মুখের অবয়ব। মুখটা ফোলা, শান্ত, চোখ বন্ধ, ধারণা করা হয়, এতে পরিশ্রান্ত অবস্থা বোঝানো হচ্ছে। আর নাকের কাছে একটা ঘাসফড়িং তার পেটে আবার পিঁপড়া। দালি ছোটবেলায় ঘাসফড়িং প্রচণ্ড ভয় পেতেন। এখানে তিনি বোধ হয় তাঁর ভয়টাকেই প্রকাশ করেছেন।

একটা নারীর মুখ পুরুষাঙ্গের কাছে গিয়ে থমকে আছে। এটা বোধহয় তাঁর মৈথুনের ফ্যান্টাসি ছিল। পুরুষটার পায়ের কাছে রক্ত ঝরছে। এতে কি খোজাকরণ বোঝানো হয়েছে? হতে পারে। ছবিতে আরো বেশ কিছু অবজেক্ট আছে। ডিম, সিংহের মুখ, তিনটা মানুষের অবয়ব ইত্যাদি।

দালি শুধু যে ছবি আঁকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, তা নয়। ১৯২৯ সালে তিনি এবং তাঁর শিক্ষাজীবনের বন্ধু লুই বুন্যুয়েল মিলে তৈরি করেন ১৬ মিনিটের একটি শর্টফিল্ম। নাম Un Chien andalou (An Andalusian Dog)। সুররিয়ালিজম ফিল্মের মাঝে এটা ছিল প্রথম দিকের মুভমেন্ট। এবং প্রায় একশ বছর থেকে এই মুভি দর্শকদের এখনো মুগ্ধ করে রেখেছে।

দালি এমনকি হিচককের সঙ্গেও কাজ করেছেন। তাঁর ‘Spellbound’ মুভিতে তিনি ড্রিম সিকুয়েন্সগুলো তৈরি করেছেন। এবং ওয়াল্ট ডিজনির সঙ্গে তিনি একটি কার্টুন ফিল্ম তৈরির কাজেও হাত দিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি তাঁর একমাত্র উপন্যাস প্রকাশ করেন নাম ‘Hidden Faces’। এমনকি তিনি একটি অপেরাও লিখেছিলেন ‘Etre Dieu’ এবং তিনি মাঝে পোশাকের ডিজাইনও করেছেন।

ভীষণভাবে ক্যাপিটালাইজড ছিলেন সালভাদর দালি। অর্থকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ‘Liking money like I like it, is nothing less than mysticism. Money is a glory।’ এ জন্য অবশ্য কিছু মানুষ তাঁকে বাঁকা চোখে দেখেন। তিনি তাঁর খ্যাতিকে অত্যন্ত উপভোগ করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘Each morning when I awake, I experience again a supreme pleasure that of being Salvador Dali।’

তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর সুররিয়ালিস্টিক এবং এবস্ট্রাক্ট পেইন্টিংয়ের জন্য। শেষের দিকে তিনি ছবি আঁকা কমিয়ে দেন। তিনি এতটাই সফল ছিলেন যে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর ছবির জন্য দুটি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছিল। একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় The Salvador Dalí Museum, অপরটি স্পেনের ফিগুয়েরসে Theatre Museum।