আবু হাসান শাহরিয়ার : কবিতার রাজভিখিরি
‘শব্দই কবির প্রেম; সে ঢোকে নিঃশব্দ পায়ে মনে
শব্দের ডুবুরি কবি; শব্দ বাঁচে ডুব-সন্তরণে
(শব্দ / আবু হাসান শাহরিয়ার)
বেশ খানিকটা দেরিতে হলেও কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় আবু হাসান শাহরিয়ারের নামটা অন্তর্ভুক্ত হলো। একেবারেই না পাওয়ার চাইতে দেরিতে পাওয়া ভালো- এ কথা গুণীজনরাই বলে গেছেন। ইতিহাসে আগামপ্রাপ্তি যেমন আছে; বিলম্বপ্রাপ্তির উদাহরণও তেমনি বিরল নয়। যা হোক, আমরা সেদিকে না গিয়ে বরং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কবিকে অভিবাদনজ্ঞাপনপূর্বক তাঁর কবিতার ওপরই ঈষৎ আলোকসম্পাতের চেষ্টা করি।
২৫-এ জুন ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবু হাসান শাহরিয়ার। পৈতৃকনিবাস সিরাজগঞ্জ জেলার কড্ডাকৃষ্ণপুর। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে এক বছর ডাক্তারি পড়েন, তার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। সেখানেও নিজেকে মেলাতে পারেননি; অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ রেখে তিন বছর পরই সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা থেকে। পরিপূর্ণরূপে নিবেদিত হয়েছেন কবিতার কাছে; অপ্রাতিষ্ঠানিক অপরিমেয় বইপত্রের কাছে। পেশা হিসেবে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের মতোই বেছে নিয়েছেন সাংবদিকতাকে। বিভিন্ন পত্রিকার ফিচার সম্পাদক, উপসম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বপালন করে সর্বশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক আমাদের সময়ে। তবে নব্বইয়ের দশকে ‘দৈনিক মুক্তকণ্ঠ’র ‘খোলা জানালা’ নামের একটি অনন্য সাহিত্যবিভাগের সম্পাদনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পত্রিকা ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতাসমগ্র’, ‘জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত শ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘প্রামাণ্য শামসুর রাহমান’, ‘দেশপ্রেমের কবিতা’, ‘বিরহের কবিতা’, ‘জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা’, ‘রূপসী বাংলা (জীবনানন্দকৃত পাণ্ডুলিপি সংস্করণ), ‘বনলতা সেন’, ‘ছোটগল্প ৯৮’, ‘কবিদের লেখা প্রেমপত্র’ এবং ‘জীবনানন্দ দাশ : মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার’। প্রবন্ধগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে- ‘উদোরপিণ্ডি’, ‘কালের কবিতা কালান্তরের কবিতা’, ‘কবিতার প্রান্তকথা’, ‘কবিতা-অকবিতা-অল্পকবিতা’ এবং ‘কবিতার বীজতলা’।
ব্যক্তিজীবন ও প্রতিপার্শ্বচিন্তা থেকে লিখেছেন ‘অর্ধসত্য’, ‘সমাত্মজীবনী : মিডিয়া ও প্রতিমিডিয়া’, ‘পায়ে পায়ে’, ‘যাইত্যাছি যাইত্যাছি কই যাইত্যাছি জানি না’, ‘নৈঃশব্দের ডাকঘর’(মৃণাল বসুচৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে), এবং ‘আমরা একসঙ্গে হেঁটেছিলাম’। শেষোক্ত বইটি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে খ্যাত শামসুর রাহমানের নিবিড় সান্নিধ্যপ্রসূত। ‘আসমানী সাবান’ নামে একটি ছোটগল্পের বইও তাঁর আছে। আছে ‘পায়ে নূপুর’, ‘ভরদুপুরে অনেক দূরে’, এবং ‘আয়রে আমার ছেলেবেলা’ নামে কিশোর কাব্যও। তবে অন্য যা-ই থাক, তিনি কবি। তাঁর প্রকাশিত কবিতাগুলো হলো : ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’, ‘অব্যর্থ আঙুল’, ‘তোমার কাছে যাই না, তবে যাবো’, ‘একলব্যের পুনরুত্থান’, ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’, ‘এ বছর পাখিবন্যা হবে’, ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’, ‘বালিকা আশ্রম’, ‘আড়াই অক্ষর’, ‘তোমাদের কাচের শহরে’, ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ এবং ‘আবু হাসান শাহরিয়ারের প্রেমের কবিতা’ ও ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনগ্রন্থটি বহুল পাঠকপ্রিয় ও বহুসংস্করণে ঋদ্ধ।
২.
কবিতা একটি নির্মাণকলা, অন্যান্য শিল্পের মতো একেও নির্মাণ করতে হয়; কিন্তু সবার নির্মাণশৈলী নান্দনিক হয়ে ওঠে না। যার ভেতরে সত্যিকার কাব্যহৃদয় আছে, যিনি কবিতাকে আপনমনের সবচাইতে মহার্ঘ্য সত্তা হিসেবে ধারণ করেন, প্রকৃত পাঠক যার কবিতায় ভাষাশিল্পের অকপট আনন্দের সন্ধান পান; তিনিই যথার্থ কবি। তাঁর কবিতা কেবল ছন্দ-অলংকারের স্থূলমূর্তি নয়, ছন্দসৌন্দর্যহীন স্বেচ্ছাগৃহও নয়; তাঁর কবিতা সহজাত শিল্পসৌকর্যে উজ্জ্বল এক একটি নন্দনপ্রতিমা। এই প্রতীমা নির্মাণে যিনি যত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য, তিনি তত বড় কবি। স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবে অনেক কবিই কবি নয়, কবিতাকর্মীমাত্র। কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলে পাঠকের মনেও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব অনুভূত হয়। বাংলাদেশের কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্যহীন কবিযশঃপ্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। এই সংখ্যাধিক্যের বাইরে এসে যে ক’জন কবির কবিতা নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলতেই হয়, তাদেরই অন্যতম একজন আবু হাসান শাহরিয়ার। তাঁর পঙক্তিপাঠের মুগ্ধতা আমাদের আবিষ্ট করে রাখতে সক্ষম।
১৯৮৬ সালে ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’ করতে বেরিয়ে পড়েন কবি। লেখেন, ‘নৌকা থামাও। ঝাঁপ দেবো কালো জলে / ফেলে আসা পথ সাঁতারেই দেবো পাড়ি। / তোমাদের গড়া জীবনের কোলাহলে / তাকালেই দেখি মৃত মুখ সারি-সারি।’ (পুনরুজ্জীবন)। নৌকায় না গিয়ে সাঁতারেই পাড়ি দিতে চান কবি। তার মানে কি প্রথাগত, সবার পরিচিত মসৃণ পথে না গিয়ে নিজের তৈরি স্বতন্ত্র পথেই তিনি কাব্যসাধনা করতে চেয়েছেন ? হয়তো তাই। তবে ঐতিহ্যকে একেবারে বাদ দিয়ে যে নয়, বরং পুরোনোকে নতুনভাবে গড়ে; তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘খনন’ কবিতায় : ‘নতুন পুরানো হয়ে যায়, / পুরানো নতুন হয়ে আসে। / মানুষ বদলে যেতে যেতে / পেছনে তাকাতে ভালোবাসে।’ ভালোবাসে বলেই সে সামনের দিকে যেমন এগোয়, তেমনি এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হিসেবে পুরোন পথ ও প্রথাকে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় মনে করে না। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারও প্রচণ্ডভাবে সামনের দিকে অগ্রসরমান এক কবি হয়েও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাণ-লোকগাথা কোনোকিছুকেই কবিতায় অপাংক্তেয় মনে করেন না; বরং সময়োচিত সমাদরের সঙ্গে সেগুলোর স্বাতন্ত্র্যপ্রসূত ব্যবহারের মাধ্যমে নান্দনিক বাক্প্রতিমা নির্মাণ করেন। ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ কাব্যের নামকবিতাটি এ পর্যায়ের এক অসামান্য নিবেদন, যেখানে তিনি সরলতা দেখাতে গিয়ে ঠকে যাওয়া ব্যাধপুত্র একলব্যের পরিবর্তিত নতুন রূপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যান কবিতারাজ্যের অগ্রজদের উত্থানসভায়। বলেন,
এসেছি একাকী আমি একলব্য। দাঁড়িয়েছি অগ্রজের উত্থানসভায়।
দাও দীক্ষা। শব্দস্বর তুলে দাও ব্যগ্র করতলে। যুদ্ধে যাই।
লক্ষ্যভেদী শরে বিদ্ধ করি যত কূপমণ্ডূকতা। কপটতা।
ধ্বংস করি জড়ভরতের যত দিনরাত্রি। সাম্রাজ্যবিস্তার।
কিন্তু অগ্রজেরা তো ‘দ্রোণাচার্য। সাড়াশব্দহীন। / প্রাচীন কৌশলের পুরাণে উড্ডীন।’
তাই প্রতিকূলতা তৈরিই থাকে। কিন্তু সেই প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করবার প্রবল শক্তিও কবির মজ্জাগত। অতএব, দৃঢ়চিত্তেই উচ্চারণ করেন :
ফিরেছি একাকী আমি একলব্য। ফিরে আসি সহস্র ধিক্কারে।
আমি নিম্নবর্ণ। আমি হরিজন। জ্ঞাতিগোষ্ঠী যত সর্বহারা।
তবু মাটি তবু বৃক্ষ তবু জল ডেকে নেয় নিসর্গসভায়।
গড়ি মূর্তি অগ্রজের। দ্রোণাচার্য থিতু হয় মগ্নতার পাঠে।
নিরন্তর পাঠোদ্ধার। গড়ি মূর্তি। ভাঙি মূর্তি। থাকি মূর্তিমান।
ভেঙে ফেলি প্রাচীনতা। স্বয়ম্ভু স্বয়ং করি স্বমূর্তি ধারণ।
নিম্নবর্ণ বা হরিজন বলে নিজের পরিচয় দিলেও কবিতার রাজ্যে যে প্রথাগত রাজপুত্রদেরকে পরাস্ত করবার প্রস্তুতি নিয়েই তিনি হাজির হয়েছেন, সেকথাও জানান নির্দ্বিধায়: ‘সপ্তশরে পঙক্তি ছুঁড়ি। মৌনতায় কথা।/ ছিন্ন করি অর্জুনের অহং-কুলীনতা।’ তথাকথিত শ্রদ্ধাবোধের ঐতিহ্যে, প্রথাগত আভিজাত্যের মোড়কে যোগ্যকে যারা দাবিয়ে রাখতে চান, তাদের প্রতি চূড়ান্ত সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন,
পুরাণে আর আস্থা নেই। জীবন খেয়ে বাঁচি।
অসূয়া যেন না-বাঁধে ঘর ক্ষমার কাছাকাছি।
যদিও একলব্য তবু ভুলিনি অপমান।
পুনর্বার হব না তাই ক্ষমাঅন্তপ্রাণ।
কবির পুরাণে আস্থা না রাখার বিষয়টি সরলরৈখিক নয়। কবি আসলে পুরাণের প্রথাগত নির্মাণে আস্থাশীল না থাকার কথা বলেছেন। পুরাণকে সঙ্গে নিয়েই পুরাণের নবনির্মাণের পথে হেঁটেছেন। পুরাণের পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্য-নৃতত্ত্ব ইত্যাদিকে সঙ্গে নিয়েও রচনা করেছেন পঙক্তির পর পঙক্তি। প্রাচীনের বিনির্মাণে রূপায়িত করেছেন বর্তমানের দিনযাপন। ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’ কাব্যের ‘ফেরে না মুন্সির বেটা, ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’ নামক কবিতায় লিখেছেন, ‘বিদ্যুৎ আসেনি শুনে রাত্রি জাগে হরপ্পার চাঁদ। চরবাউলের মেয়ে পাড়তলী মেঘনায় সাঁতার শিখেছে। গাজনের মেলা বসে মতিনের কবরের পাশে। রূপসী ডোম্বীরা আজও কুপি জ্বালে চর্যার দোহায়। বিরান মাঠের পাড়ে মুন্সিবাড়ি- ঢেঁকিছাটা প্রত্নশিলালিপি। তারারা দূরের আলো, গরিবের ভিটেয় চরে না। চাঁদের হ্যাজাক জ্বেলে ঢেউ গোনে ঘাটের হিজর। খ্যাতির বাদুড় ঝোলে নাগরিক ইলেকট্রিক তারে। ধীবর ভাসায় ডিঙি, দাঁড়ে বাজে জলের দোতারা। ফেরে না মুন্সির বেটা, ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ। চাঁদের কলঙ্ক আছে, জীবনেরও মুদ্রণপ্রমাদ।’ এই কাব্যের অধিকাংশ কবিতাতেই পুরাণ-ইতিহাস-ঐতিহ্য-নৃতত্ত্ব-শিল্পী-শিল্পতত্ত্ব-সমকাল সব একাকার হয়ে অনন্যসাধারণ সমস্ত পঙক্তিনির্মাণের পাথেয় হয়েছে। ‘কালের কলমে লেখা আমাদের শব্দজনপদ’ কবিতায় দেখি :
দরোজায় খ্রিস্টপূর্বকাল। কড়া নাড়ে সাফোর কবিতা। কালের কলম কবি, চিঠি লেখে হাতের কলমে। ঢাকার ঘড়িতে বাজে সুদূরিয়া এথেন্স নগরী। রূপসী সাফোর প্রেমে মজেছিল সক্রেটিস মুনি। আমিও মজেছি তার কবিতার নুনে। ... জীবনে শিলালিপি কবিতার খাতা। কালের কলমে লেখা আমাদের শব্দজনপদ। মুছে গেছে কত নাম, ফিরে গেছে কত মহাজন। সে-কথা জেনেও কত-শত কবি জড়ো হয় এ পোড়া শহরে। যত না লেখায় বড় সমকাল, তারও বেশি নামের বহরে।
কবি জানেন সমকাল তাঁর শরীরি আবাসক্ষেত্র হলেও তাঁকে ভ্রমণ করতে হয় মহাকালের অপরিমেয় পথপরিক্রমায়। ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’ কাব্যের ‘পাটিগণিতের মাঠ হিসেবের বানে ভেসে গেছে’ কবিতার পুরোটাই যেন অসামান্য মহাকালযাত্রার অভিপ্রায়ে তুলে ধরেছে নৈতিকতাবিরল সমকালকে :
ভিসুভিয়াসের চুড়ো বরফে ঢেকেছে। স্পার্টাকাস নেই, আছে দাসপ্রথা, আরো আছে নিরন্নের কাল। হাটে যাবে জনশক্তি, কড়ি গোনে মন্ত্রিপরিষদ। পাটিগণিতের মাঠ হিসেবের বানে ভেসে গেছে। লেলিনের ভাঙামূর্তি ক্রাচে চড়ে জোড়াসাঁকো আসে। ফুটপাথে পড়ে আছে ছেঁড়াখোঁড়া রাশিয়ার চিঠি। সে চিঠি কে পড়ে বলো, পরচর্চা ফণা তুলে নাচে। ধনে জনে লক্ষ্মীলাভ, সরস্বতী উলুবনে একা। ইশকুলের বাঁধাপথে বাড়ি ফেরে কিশোরী রাধিকা। আজ ধর্ষকের দিন, কৃষ্ণ গেছে দূর পরবাসে। ইতিহাস মাথাগোঁজে মৌলবাদী শিশ্নসমাবেশে।
‘তোমাদের কাচের শহরে’ কাব্যের ভিন্নস্বাদের ‘হায় কৃষ্ণ কোথায় ?’ নামক কবিতায় এই সময়ের প্রেমিক, বুদ্ধিজীবী, বিরাট সংগঠন সবকিছুকেই সমকালের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন যাচিতরূপেই :
এই মাঠে একতারা কাঁদে, ঐ মাঠে দোতারা
বাড়িতে ফেরেনি রাধা, গোপবালিকারা
রূপে এসিডদগ্ধ
রূপে এসিডদগ্ধ তাই বিদগ্ধ সুশীলসমাজ ভাবে
বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দুনিয়া কাঁপাবে
...
মুখর দিনগুলো কই ভাপা-চিতই সবার পাতে-পাতে
বাস্তুঘুঘু শাস্ত্র হাতে বসেন পঞ্জিকাতে
আসেন জাতিসঙ্ঘ
আসেন জাতিসঙ্ঘ রঙ্গব্যঙ্গ করেন পৃথিবীতে
দেবতাদের তুষ্ট রাখেন প্রার্থনা-সঙ্গীতে
গ্রাম-প্রধান বাংলার অন্ত্যজ মানুষের প্রতি কবির রয়েছে গভীর সমর্থন। মাটিবর্তী মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, তাদের অহমিকাহীন আত্মকর্মপ্রসূত জীবন-যাপন কবিকে যে প্রভাবিত করে সেকথা আছে একাধিক কবিতায়। তবে ‘মাটি-বংশধর’ কবিতাটিই বোধ হয় এ পর্বের সবচাইতে চমকপ্রদ নির্বাচন। এখানে কবির নবচিন্তিত শব্দশর খুব সাধারণ পাঠক-শ্রোতাকেও বিদ্ধ করতে সক্ষম। তিনি যখন বলেন, ‘আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা / আমার বাপের নাম কে না জানে- চাষা-মালকোঁচ / আমি গামছা-কুমোরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী যত নিম্নজনা / ধুতি-গোয়ালারা জ্ঞাতি খড়ম-তাঁতিরা / আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা।’ কিংবা ‘আমার বউয়ের নাম কাঁচাসোনা, তোমাদের মতো বুকে কাঁচুলি পরে না / স্তনে মুখ ঘ’ষে দিয়ে চলে আসি, ঝাঁপিখোলা-ঝাঁপিবন্ধ নেই।’ তখন সাধারণ মৃত্তিকাশিল্পী থেকে শুরু করে অভিজাত লেখিকাও আবিষ্ট হয়ে পড়েন। ‘ব্রাত্যগীতিকা’তে লোকপুরাণের চন্দ্রাবতী, চর্যাকবি শবরপা’র কথা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে স্মরণ করেছেন শাহরিয়ার। নিজেকে ‘কালের ধীবর’ বলেছেন, কিন্তু ঘুরতে চেয়েছেন কালান্তরে। জীবনকে নিরন্তর পাঠ করে যাওয়া কবি ভালোভাবেই জানেন আকাশ-মাটি-নদী-বৃক্ষ ছাড়া প্রকৃত কবিকে পাহারা দেওয়ার কেউ নেই; অন্য কারো কাছে নতিস্বীকারের কিছু নেই। নেই বলেই খ্যাতির কাঙালপনা করতে গিয়ে আত্মসত্তাকে বিসর্জন দিতে উন্মুখ জনতার দেশে একজন শাহরিয়ার বলে ওঠেন, ‘যা রে খ্যাতি উড়ে যা রে আলোকে-আগুনে / আমি শুধু অন্ধকার চিনি / থোকা থোকা মৃত্যু আর অমাবস্যা কিনি।’ (ট্যাবু ও টোটেম)।
৩.
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দে কবির বিপুল আস্থাই শুধু নয়, ব্যাপক নির্ভরতাও আছে কবিতা ও কবিতাভাবনার ক্ষেত্রে। আরো অসংখ্য পূর্বসূরী দীপ্তিমানবৃন্দ তাঁর চিন্তা ও কবিতারাজ্যের পঙক্তিমালায় স্থান করে নিয়েছেন। তিনি জানেন মহান পূর্বজদের সম্মান করতে না জানলে আত্মার উত্তোরণ ঘটে না। এজন্য পূর্বসময়ের তো বটেই নিজের সময়ের অগ্রজ ও অগ্রবর্তী অসামান্য কবিদের প্রতিও আবু হাসান শাহরিয়ারের শ্রদ্ধা অপরিসীম। প্রবন্ধের পাশপাশি কবিতাতেও এই সম্মুখবর্তীদের প্রতি নিবেদন করেছেন মুগ্ধপাঠ পঙক্তিগুচ্ছ। ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’ কাব্যের ‘কত রাজ্য মুছে গেছে, ফিরে গেছে কত মহাজন’ কবিতায় কোনো মাটি, কোনো রাজ্য চিরস্থায়ী নয় জেনেই লিখেছেন ‘নতুন মাটিতে দ্যাখো মাথা তোলে নতুন কবিতা। নতুন শব্দের শীষে নবাগত স্বপ্ন লেখে নাম। ... কত রাজ্য মুছে গেছে, ফিরে গেছে কত মহাজন। টিপু সুলতানের সাথে অস্ত গেছে ব্যস্ত মহীশূর। কালিদাস নেই, এসে ফিরে যান শক্তি-শামসুর।’ আরেক অসামান্য অগ্রজ শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে ‘তোমাদের কাচের শহরে’ কাব্যের ‘শঙ্খদার চিঠি’তে লিখেছেন : ‘একার সন্ন্যাস কবি ; তাকে চেনা যায় / বিজনের বাঁকে / কবিতায় ষোল আনা- চিঠিতেও পাই / ধ্যানী শঙ্খদাকে’। চূড়ান্ত অসুস্থশয্যায় শায়িত কবি রফিক আজাদকে নিয়ে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার রফিক আজাদ’ শিরোনামে লিখেছেন :
জ্যোতিরিন্দ্র প্রশ্ন করেছিল- আজ কোথায় যাবেন?
সাফো যায়, সাফো শুধু যায়
যেতে তো শক্তিও পারে, কিন্তু কেন যাবে?
তবু যায়, সুনীল শামসুরও চলে যায়
সব বাদ অস্ত গেলে থাকে মৃত্যুবাদ
মৃত্যুর এপারে বসে
গ্র্যান্ডমাস্টার চালে দাবা খেলে রফিক আজাদ
কেবল যোগ্যদের প্রশংসা করেই নয়, অযোগ্যদের বিদ্রূপ করেও একাধিক পঙক্তি লিখেছেন শাহরিয়ার। কিন্তু সেদিকে আপাতত যেতে চাই না। যেতে চাচ্ছি না তাঁর অসামান্য প্রেমের পঙক্তিরাজ্যেও। ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’, ‘বালিকা আশ্রম’ এবং ‘আড়াই অক্ষর’ নামের কাব্যত্রয় বক্তব্যের সুন্দরত্বের পাশাপাশি আঙ্গিকের বিচারেও বাংলাদেশের কবিতারাজ্যের অনন্য সংযোজন। সে বিষয়টিও পর্বান্তরে বিশদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
আবু হাসান শাহরিয়ার কবিতার বিস্তৃত পটভূমিকার কবি। বিশাল ক্যানভাসে বৈচিত্র্যময় পথে হাঁটতে সচেষ্ট তিনি। তাঁর কবিতারাজ্যের অনেক পঙক্তিই মুগ্ধপাঠ স্মরণীয়তা দাবি করে। যেমন :
১. মানবতরল।
যখন যে পাত্রে বাস, প্রতিবিম্ব তারই।
২. হাজার নারীর পুরুষ আমি, থাকি তেপান্তরের মাঠে-
ছন্দ যদি শিখতে পারো, শরীর দেবো কাব্যপাঠে।
৩. আমি জীবনকাব্যে বাঁচি, তাই ডেকেছি কবির নিলাম-
নামদুরস্ত কেতাব-কবির নামের পাশে শূন্য দিলাম।
৪. আমি হাজার কাব্য পড়ি, পাঠ করি আর বিদায় জানাই
দু’চারখানা সঙ্গে রাখি, হৃদয় ঠুকে নৌকা বানাই।
৫. মানুষ হয়েই জন্মেছিলাম, তারপরও দিই নীরব সায়-
লজ্জাতে হই আনতশির ‘মানুষ’ নামের অযোগ্যতায়।
৬. বাঁশিতে মজেনা গোপবালিকারা, এ বড় আজব কলিকাল। সিঁদকাঠি হাতে নিয়ে দেশে ফেরে ব্রজের
রাখাল।
৭. যাদের যৌবন গেছে ভারি-ভারি পুস্তকের নিচে, তারাই বার্ধক্যে খোঁজে কিশোরীর পাজামার ফিতে।
৮. মশারা বাস্তববাদী, ম্যালেরিয়া ডেঙ্গু নিয়ে আসে। মিডিয়ায় পাখি নেই, মশারাই খ্যাতির শিখরে।
দুয়ারে ধর্মের ষাঁড়, উলুবনে চামচিকে ওড়ে।
৯. অমিতসম্ভাব্য কবি ভালোবাসে একার সন্ন্যাস।
১০. বাজালে পাথরও বাজে; কঠিন পাহাড়ই সব সুরস্রোতা নদীর জননী।
উদাহরণ বাড়াতে চাই না। বলতে চাই তিনি কবি। যথার্থই কবি। কবিতা তাঁর হাতে শৈল্পিক সুষমায় সুর তোলে। তাঁর যেমন পাঠের গভীরতা ব্যাপক, তেমনি তাঁর কবিতাপাঠেও পাঠকের কাব্য-আস্বাদনের অনন্যতা বিরাট।
যদিও প্রকৃত কবির জন্য দশক কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; আবু হাসান শাহরিয়ার সেটা প্রত্যাখ্যানও করেন; তথাপি কবির আবির্ভাবকালকে চিনবার জন্য যে সময়সীমা দরকার হয়, সেই হিসেবে তিনি গত শতকের সত্তরের দশকে আবির্ভূত এক তরুণ কবি। তরুণ তিনি তখনো যেমন ছিলেন, এখনো। মনের তারুণ্য চিরকালের বিষয়; সত্তরোর্ধ রবীন্দ্রনাথও তরুণদের উদ্দেশ্য করেই লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ শাহরিয়ার বলেন, ‘প্রকৃত কবি আমৃত্যু নবীন।’ নবীন বলেই কোনো প্রকৃত কবিকে কোনো নির্দিষ্ট দশকের তোষকে আবদ্ধ করে রাখা যায় না; যায় না যেমন শাহরিয়ারকেও। তা ছাড়া তিনি তো নিজেই বলেছেন,‘আমার কোনো দশক-শতক নেই। আছে না লেখা কবিতার প্রতি এক অদম্য টান। না-দ্যাখা বাঁকের প্রতিও। সেই টানেই লিখি।’ কবিতায় লিখেছেন, ‘দশক বাড়ি ফেরে, শতকও মুছে যায় / সময় শাদাপাতা অধরা শিলালিপি।’ আমরাও চাই দশক-শতক মিলিয়ে যাক; বেঁচে থাক একজন আবু হাসান শাহরিয়ার। এবং বলতেই চাই অভিনন্দন, হে কবি ! কবিতার রাজভিখিরি!