আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ ডব্লিউ বি ইয়েটস

Looks like you've blocked notifications!

আয়ারল্যান্ডের কবি, নাট্যকার এবং বিশ শতকের সাহিত্যাঙ্গনের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের এক প্রবাদ পুরুষ। তাঁর সাহিত্যকর্মে কেল্টিক সাহিত্য, লেডি গ্রেগরি এবং অ্যাবি থিয়েটারের স্থপতি এডওয়ার্ড মার্টিনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান।

ইয়েটসের জন্ম ও পড়াশোনা ডাবলিনে। কিন্তু তাঁর শিশুকালের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আয়ারল্যান্ডের শহর কাউন্টি স্লিগোতে। যুবক বয়সেই তাঁর কবিতা পড়ার শুরু এবং এই বয়সেই তিনি আয়ারল্যান্ডীয় কিংবদন্তিগুলো ও অকাল্ট সাহিত্যের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তাঁর প্রথম পর্যায়ের কাজগুলোজুড়ে এই প্রভাব দেখা যায়। উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত তাঁর এই কাজের ধারা চলতে থাকে। তাঁর সর্বপ্রথম কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে। ইয়েটসকে ধরা হয় ঐতিহ্যগত ভাবধারার অত্যন্ত দক্ষতাসম্পন্ন একজন কবি।

১৮৬৭ সাল। ছেলে ইয়েটসের বয়স তখন দুই বছর। ওই বয়সে বাবা জন বাটলার ইয়েটস চিত্রশিল্প শেখার জন্য সপরিবারে স্থানান্তরিত হন লন্ডনে। ১৮৭৭ সালের ২৬ জানুয়ারি, শিশু উইলিয়ামের স্কুলযাত্রা শুরু হয়। তাঁকে ভর্তি করা হয় লন্ডনে, হেমারস্মিথের অন্তর্গত ডলফিন স্কুলে। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়ালেখা করেন। স্কুলের রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি খুব ভালো মানের ছাত্র ছিলেন না। এদিকে লন্ডনে অবস্থান করে তত দিনে দারুণ আর্থিক সংকটে পড়ে যান বাবা জন ইয়েটস। ফলে ১৮৮০ সালে ফের ডাবলিনে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তাঁদের পরিবার। সেখানে ১৮৮১ সালের অক্টোবরের দিকে উইলিয়াম আবার তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তাঁর পরিবারের সবাই ছিল শিল্পমনা। মা সুসান মেরি পলেস্কফেনের কাছ থেকেই আইরিশ লোকগাথার পরিচয় পান উইলিয়াম ইয়েটস।

বাবার স্টুডিওর কাছেই ইরাসমাস স্কুলে ভর্তি করা হয় উইলিয়ামকে। ফলে শহরের বড় বড় চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮৮৪ সালে দুই বছরের জন্য ভর্তি হন ডাবলিনের ‘মেট্রোপলিটন স্কুল অব আর্ট’ স্কুলে। এ সময় তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন।

১৮৮৫ সালের ২১ অক্টোবর তাঁর ‘দ্য পোয়েট্রি অব স্যামুয়েল ফার্গুসন’ শিরোনামের কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ডাবলিন ইউনিভার্সিটি রিভিউতে। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম শুরু করেন মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকেই। উইলিয়ামের প্রথমদিকের কবিতাগুলো ছিল শেলী এবং এডমন্ড স্পন্সার দ্বারা প্রভাবিত। পরে তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রি-রাফায়েল, আইরিশ লোকগাথা এবং সংস্কৃতিক প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি উইলিয়াম ব্ল্যাকের সৃষ্টিকর্মের গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন।

১৮৮৭ সালে ইয়েটস পরিবার আবার স্থানান্তরিত হয় লন্ডনে। সেখানে একদল ব্রিটিশ কবি নিয়ে তিনি গঠন করেন রাইমার্স ক্লাব। পরে সেটি ট্রেজিক জেনারেশন হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৮৯২ এবং ১৮৮৪ সালে সে সংগঠন থেকে দুটি সংকলন প্রকাশিত হয়। ডাবলিন ইউনিভার্সিটি রিভিউতে ‘দ্য আইল্যান্ড অব স্টেডিউস’ নামে উইলিয়ামের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা প্রকাশিত হয়, যাতে তিনি স্পন্সার এবং শেলীর কাব্যিক মডেল অনুসরণ করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে ইয়েটস প্রতি গ্রীষ্মে চলে যেতেন ডাবলিনে। লন্ডনে অবস্থান করলেও ডাবলিনই ছিল যেন তাঁর প্রাণের শহর।

১৮৮৬ সালে তিনি স্বতন্ত্রভাবে প্রথম কাব্য-পুস্তিকা (পেমফ্লেট) ‘মসোজ : এ ড্রামাটিক পোয়েম’ প্রকাশ করেন। তাঁর ‘দ্য উয়ান্ডারিংস অব অয়িসিন অ্যান্ড আদারস পোয়েমস’ প্রকাশ পায় ১৮৮৯ সালে। এ সালেই তিনি আইরিশের জাতীয়তাবাদী ও নারীবাদী কবি মট গনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ধীরে ধীরে তাঁকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন। তাঁর প্রতি তিনি এতটাই অনুরুক্ত হন, ১৮৯৯, ১৯০০ এবং ১৯০১ সালে পর পর তিনবার বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু বার বার তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। তাঁর একান্ত পছন্দের সেই মট গন ১৯০৩ সালে বিয়ে করেন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী মেজর মেক ব্রাইটকে। মট গনের বিয়ের পরও কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। আর সেই মট গনই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা লেখার অন্যতম প্রেরণা। বিয়ের ১৩ বছর পর অর্থাৎ ১৯১৬ সালে মট গনের স্বামী মেক ব্রাইট মারা যান। সে বছরই বিধবা মট গনকে আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হন উইলিয়াম ইয়েটস।

মট গনের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসা এবং তাঁকে না পাওয়ার বেদনাজাত উপলব্ধি থেকে সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অনেক বিখ্যাত কবিতা। তিনি ছিলেন বেশ কল্পনাপ্রবণ এবং স্বপ্নবিলাসী কবি। আয়ারল্যান্ডের সাধারণ মানুষের লোকসংস্কার, লোকগাথা ও ব্যালাডে ছিলেন বিমুগ্ধ। তাঁর কবিতা বুঝতে হলে সেই দেশের অতিপ্রাকৃত ও জাদুবিশ্বাস, ধর্মতত্ত্ব ও প্রতীকীবাদ সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।

১৮৯৯ সাল। উইলিয়ামের বন্ধু এডওয়ার্ড মার্টিন, লেডি গ্রেগরি এবং জর্জ মুর সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাবে থিয়েটার বা আইরিশ লিটারেরি থিয়েটার। এটি আইরিশদের জাতীয় থিয়েটার হিসেবেও পরিচিত হয়। আইরিশ জাতীয় আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা পালন করে এ থিয়েটার। বলা যায় জাতীয়বোধ এবং স্বদেশপ্রেমই ছিল আইরিশ নাট্য আন্দোলন ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দিক।

১৯১১ সালে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের বয়স যখন ৫১, তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ হাই লিজ নামে এক তরুণীর। বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। ১৯১৭ সালের ২০ অক্টোবর সেই  বান্ধবীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বয়সের অনেক পার্থক্য থাকার পরও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। উইলিয়ামের সৃষ্টিকর্মে স্ত্রী নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। এ সুখী দম্পতির দুটি সন্তান [প্রথমটি কন্যা-অ্যান; জন্ম ১৯১৯ সালে। দ্বিতীয়টি ছেলে মাইকেল, জন্ম ১৯২১ সালে]। উইলিয়াম তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে দুটি কবিতাও লেখেন। ১৯২২ সালে ইয়েটস আইরিশ সিনেট নির্বাচিত হন। ইংরেজি ও আইরিশ সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। জগদ্বিখ্যাত এই মহান আইরিশ কবিই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের ভূমিকা রচনা করেছিলেন।

১৯২৩ সালে উইলিয়াম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে নোবেল কমিটির বর্ণনা ছিল, ‘অনুপ্রেরণা জাগানো কবিতা, যা খুবই শৈল্পিকভাবে পুরো জাতির স্পৃহা জাগানো ভাবটিকে প্রকাশ করেছে।’ ইয়েটস ছিলেন কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মানপ্রাপ্ত প্রথম আয়ারল্যান্ডীয়। তাঁকে বলা হয় সেই গুটিকয়েক সাহিত্যিকদের একজন যাঁদের সর্বোৎকৃষ্ট কাজগুলো লিখিত হয়েছে নোবেল পুরস্কার জয়ের পর।