সফরের অভিজ্ঞতা
পশ্চিমবঙ্গ, সাত দিনের মফস্বল
১.
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের অবস্থা এবং বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে প্রায় কোনো ধারণাই নেই পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলবাসীর। কারণ, সেখানকার মিডিয়ায় কোনো স্থান নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের খবর বলতে শেখ হসিনার কিছু কথা থাকে অনেক দিন পরপর। সেটাও ভারতের প্রশংসা করে বলা কথা। আর বাংলাদেশের কোনো টিভি বা রেডিও চ্যানেল যেহেতু সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না, তাই সাধারণ মানুষের কোনো উপায় নেই আমাদের দেশ সম্পর্কে জানার।
এ কথা কেবল সাধারণ মানুষ সম্পর্কেই নয়, বরং সেখানকার রাজনীতি-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাছে ‘ফরেনার’। কলকাতার মানুষের কাছেই যেখানে বাংলাদেশ মানেই এখন হয় মৌলবাদী হামলায় জর্জরিত দেশ, অথবা কাদের-নিজামীদের ফাঁসি দেওয়ার দেশ। আর হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়ার দেশ। সেখানে মফস্বলবাসী আর কী ভাবতে পারেন নিজে নিজে? তবে তাঁদের জানার ইচ্ছাটা কিন্তু প্রচণ্ড। অসংখ্য প্রশ্ন তাঁদের। বাঙালি, বিহারি, সাঁওতাল, বাউরি, শিক্ষক-ছাত্র, সংস্কৃতিকর্মী—সবাই বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই কৌতূহলী। আমরা যে খাদ্যশস্য উৎপাদনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে বিশাল অঙ্কের, আমরা যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়াই শুধু নিজেদের সম্পদ দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছি—এসব তথ্য তাঁদের কাছে রূপকথার মতো।
২.
বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরন্তর ভারতে চলে যাওয়ার ব্যাপারটি আমি সরাসরি স্বীকার করে নিয়েছি। বহুমাত্রিক কারণগুলো জানানোর চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে প্রশ্ন করেছি—আপনাদের এখানে কি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দলিতরা নিরাপদ? উত্তরে সবাই বলেছেন যে তাঁরা কেউ নিরাপদ নন, নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন সর্বদা। নিগ্রহ ভোগ করেন, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন, নারীরা ধর্ষিতা হন, পুরুষরা নিহত হন, সামাজিক মর্যাদাহানির শিকার হন প্রতিনিয়ত। সরকারি চাকরিতে মুসলিম এবং নিম্নবর্গের মানুষের শতকরা অবস্থান রীতিমতো শোচনীয়। বাংলাদেশের তুলনায়ও খুবই শোচনীয়। তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অন্যত্র চলে যেতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গের উনারা অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবেন না। কারণ, অন্য কোথাও যে যাওয়া যেতে পারে, সেটা তাঁরা জানেনও না। খুবই সত্যি। কারণ, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তো আর তাঁদের ধারণ করতে পারে না।
তবে এঁদের মধ্যে যাঁরা একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে দেশত্যাগী হিন্দুদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করেন। এখানকার সব হিন্দুই নাকি বিশাল বিশাল জমিদারি ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। একজন বললেন, শুধু শিয়ালদহে যেসব বাঙাল (বাংলাদেশের হিন্দু) এসে উঠেছে, তাদের ফেলে আসা সম্পত্তির যোগফল বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে।
আরএসএস নাকি কয়েক দিন আগে দাবি করেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ কোটি হিন্দু বিতাড়িত হয়েছে। এই সংখ্যার কথা অবশ্য উনারাও বিশ্বাস করেন না বলে জানালেন। তবে ভারতের বিশাল প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী এই রকম গালগল্পও বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন এবং প্রচারও করেন।
তবে ব্যাধিটা যে আছে, ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
৩.
মিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে যতটুকু জানায়, তার ভিত্তিতে ওখানকার লোকেরা বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশে কেবল দুই ধরনের মানুষ আছে। একদল ভারতপন্থী, আরেকদল ভারতবিরোধী।
আমরা যে ওই রকম মোটাদাগে বিভক্ত নই, সে কথা জেনে উনারা অবাকই হলেন। আমি যখন জানালাম যে ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে আমাদের, দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক পুরোনো, এটা একটি দিক। আরেকটি দিক হচ্ছে কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে এবং সেই ইস্যুগুলোর সমাধান যে ভারতের কারণেই হচ্ছে না, সেটাও সত্যি। সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ভারত সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গেও আমাদের দ্বিমতের কথা জানালাম।
তবে পানিপ্রবাহের সমস্যার কথাটা কেউ কেউ জানেন। তাঁরা রাজনীতির বাইরে অবস্থান নিয়ে খুবই মানবিকভাবে বললেন—পানি যারা আটকায়, তাদের দুর্ভিক্ষ কোনো দিন শেষ হয় না। এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ভারতের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যে খেতে পায় না ঠিকমতো, তার অন্যতম কারণ হিসেবে জল আটকানোর পাপটিকেও নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন তাঁরা।
৪.
বাংলাদেশ থেকে দলে দলে রোগী ভারতে ছোটে চিকিৎসার জন্য। রোগীদের এই ভারতযাত্রার কারণ খোঁজার চেষ্টা করার দায়িত্ব আমাদের দেশের সরকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগের। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ তো দেখা যায় না। তাই নিজেই কৌতূহল নিয়ে ওখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা দেখার চেষ্টা করি। পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলে চিকিৎসার অবস্থা ভয়াবহ। লোকজন জানাল, সারা ভারতেই সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার একই চেহারা। তাই দূর মফস্বলেও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ক্লিনিক-নার্সিং হোম-বেসরকারি হাসপাতালের উজ্জ্বল সাইনবোর্ড।
আমাদের দেশে একটা মিথ ছড়ানো হয়েছে। তা হচ্ছে, ভারতে বেসরকারি চিকিৎসার খরচটা বাংলাদেশের থেকে অনেক কম। ডাহা মিথ্যা কথা। ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় বিরাট করে বেরিয়েছে একজন রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভাঙচুরের খবর। জানা গেল, পারফোরেশন অব বাওয়েল নিয়ে ১৬ বছরের একটি মেয়ে ভর্তি হয়েছিল সেই হাসপাতালে। অপারেশনের জন্য রোগীর কাছে দাবি করা হয়েছিল দেড় লাখ ভারতীয় রুপি। গরিব মা-বাবা ৪০ হাজার রুপি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি টাকা জোগাড় না করা পর্যন্ত রোগীর অপারেশন করতে রাজি হয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল রোগী। সেই ক্ষোভে রোগীর এলাকার মানুষ ভাঙচুর করেছে হাসপাতাল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আনন্দবাজার পত্রিকা এমনভাবে খবরটা তৈরি করেছে, যাতে দেখানো হয়েছে যে প্রায় বিনা চিকিৎসায় রোগীর মারা যাওয়াটা কোনো ঘটনা নয়। ঘটনা হচ্ছে হাসপাতাল ভাঙচুর। কারা কারা ভাঙচুরে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের ছবি প্রথম পাতায় গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছে আনন্দবাজার। এবং যেভাবে খবরটি পরিবেশন করা হয়েছে তাতে বোঝা যায়, হাসপাতালের অমানবিক অবহেলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে অবিলম্বে রোগীর আত্মীয়দের গ্রেপ্তার করানোটাই তাদের মুখ্য দাবি।
এ ধরনের অপারেশন আমাদের দেশের জেলা শহরগুলোতে সব মিলিয়ে খরচ পড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা। ঢাকায় সেটি ৬০-৭০ হাজার হতে পারে। কিন্তু কলকাতায় দেড় লাখ রুপি! ভারতে সস্তায় চিকিৎসার প্রপাগান্ডা যাঁরা ছড়িয়ে বেড়ান, তাঁদের মুখে স্কচটেপ আটকে দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের রোগীরা সস্তায় উন্নত চিকিৎসার নামে ভারতে গিয়ে গলাকাটা দিয়ে আসছে। আমার মনে হয়, আগামী বছর দশেক পর পূর্ব ভারতের রোগীরা চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে আসবে।
৫.
বেসরকারীকরণের ভালো একটা দৃষ্টান্ত দেখা গেল এবার। পশ্চিমবঙ্গের আমলাদের জন্য নতুন গাড়ি কেনা প্রায় বন্ধ। গাড়ি কিনলে তার জন্য ড্রাইভার নিয়োগ, তেল-মবিল খরচ, তেলচুরি, মাসে মাসে নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং সার্ভিসিংয়ের নামে টাকার শ্রাদ্ধসহ নানা রকম হ্যাপা। তার বদলে এখন মাসকাবারি চুক্তিতে বেসরকারি গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। সরকার মাসে মাসে একটা টাকা ধরিয়ে দেয়। বাকি সব হ্যাপা গাড়ির মালিকের।
বাংলাদেশ সরকার আমলাদের জন্য শত শত গাড়ি কিনেই চলে। সব জায়গায় বেসরকারীকরণের ঢক্কানিনাদ। তবে অবশ্যই সামরিক-বেসামরিক আমলারা সব ধরনের বেসরকারীকরণ থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত।
৬.
বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে ভারতের সাধারণ মানুষকে অজ্ঞ করে রাখা এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে রাখার পেছনের কারণটা কী?
ভারতের মানুষ জানে, বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ভয়ংকরভাবে পিছিয়ে পড়া দেশ। এই দেশের মানুষ খেতে পায় না। কাজ পায় না। কাজ করতে সীমান্ত টপকে ভারতে ছোটে। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক চাকরি করে বাংলাদেশে। ভারতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে যে রেমিট্যান্স যায়, তার পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাদেশের নাম। এই তথ্য জেনে তো সেখানকার মানুষ আকাশ থেকে পড়ে প্রায়!
সেখানকার একজন চিন্তাশীল মানুষ আমাকে বললেন, পাকিস্তান বা চীন যতটা ভয়ের কারণ ভারতের, তার চেয়ে বেশি ভয়ের কারণ বাংলাদেশ। কারণ, ভারতের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মানুষ যদি জানতে পারে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ফলে বাংলাদেশের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা, তাহলে তারাও স্বাধীন হতে চাইতে পারে।
এটি হয়তো নেহাতই একটি খেয়ালি ধারণা।
প্রচণ্ড দুর্নীতি, শাসকগোষ্ঠীর দেশপ্রেমহীনতা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র—সবকিছুর পরেও বাংলাদেশটাকে এগিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের অদম্য প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের মানুষের অদম্য এই প্রাণশক্তির কথা জানতে পেরে তাঁরা একই সঙ্গে বিস্মিত এবং আনন্দিতও।
(১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি-২০১৭, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি মফস্বল অঞ্চলে কাটিয়ে এসে লেখা।)