মুক্তগদ্য
বৃষ্টিভেজা অপূর্ব বর্ষা
আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে মেঘমাসৃষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজ প্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।’
-মেঘদূত
বহুকাল আগে এভাবেই কালিদাস মুগ্ধ হয়েছিলেন আষাঢ়ের রূপে। আষাঢ়। শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা গুরুগম্ভীর ভাব আছে, আছে স্বপ্নাবিষ্ট এক মোহময়তা। গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ঠ প্রাণকে শীতলতা দানে জুড়ি নেই বর্ষাকালের। প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষের কাছে বর্ষা নিয়ে আসে অভিনব ব্যঞ্জনা আর কবিদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। বর্ষার ফুল দিয়ে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছি দান’ বলে।
আষাঢ় থেকে বর্ষার শুরু হলেও টানা ভাদ্র অব্দি চলে বৃষ্টির চঞ্চল খেলা। প্রিয়া বিনে শূন্য মনে হয় মনের মন্দির। বিদ্যাপতির কাতর সুরে ধ্বনিত হয়-
‘হে সখী হামারি দুখের নাহি ওর,
এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।’ (বৈষ্ণব পদাবলী)
বর্ষা বাঙালি জীবনে নতুন প্রাণসঞ্চারকারী একটি নাম। বৃষ্টিস্নাত কদম ফুলের সৌন্দর্য্য যে দেখেছে, মুগ্ধ নয়নে চেয়ে না থেকে পারেনি। সেই মুগ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেননি পল্লীকবি জসীমউদদীনও-
‘বনের ঝিয়ারি কদম্বশাখে নিঝঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে, অস্ফুট কলিকায়।’ (পল্লী বরষা)
বর্ষার বৃষ্টি ও গম্ভীরণাদি মেঘগর্জন মনকে আকুল করে তোলে, প্রাণে জাগায় অপূর্ব শিহরণ। বর্ষার ভয়ংকর অথচ অসাধারণ রূপকে প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন-
‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ রভসে।
ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরষা।’ (বর্ষা মঙ্গল)
আবার প্রিয়জনদের কাছে ধরে রাখতে বর্ষার দোহাই দেওয়ার কৌশলও তিনি অবলম্বন করতে ভোলেন না-
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে, তিল ঠাঁই আর নাহিরে,
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ (আষাঢ়)
বর্ষার একটানা বৃষ্টি চেতনালোকের বন্ধ দ্বার যেন উন্মুক্ত করে দেয়। নিভৃতে ঘরের কোণে বসে থাকা মনও চায় একান্ত গোপনে বর্ষার মোহময় অন্ধকারে নিজেকে ঢেকে অন্তরালের কাউকে মনের কথা খুলে বলতে; রবীন্দ্রনাথের কাব্যে তারই প্রকাশ-
‘এমন দিনে তারে বলা যায় /এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন মেঘস্বরে- বাদল ঝরঝরে / তপনহীন ঘন তমসায়।’ (বর্ষার দিনে)
বর্ষার রূপ ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকেও আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে। বর্ষার রূপের বিচিত্র শোভা তিনি বর্ণনা করেছেন চমৎকার ভঙ্গিমায়, অপূর্ব তাঁর বর্ণনকৌশল-
‘ময়ূর বলে ‘কে গো?’ এযে আকুল করা রূপ!
ভেকেরা কয় ‘নাই কোন ভয়’, জগৎ রহে চুপ;
পাগলি হাসে আপন মনে পাগলি কাঁদে হায়,
চুমার মত চোখের ধারা পড়ছে ধরার গায়।’ (বর্ষা)
নজরুলের কাছে বর্ষাকে মনে হয়েছে ‘বাদলের পরী’। বর্ষার চমৎকারিত্ব তিনি উপভোগ করেছেন অন্তর থেকে। তাই তো বর্ষার বিদায়ক্ষণে তাঁর মন বলেছে-
‘ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী।’ (বর্ষা-বিদায়)
বর্ষা শেষের ক্লান্ত ও বৈচিত্র্যময় ছবি ধরা পড়েছে সুধীন্দ্রনাথের চোখেও। তাঁকে কলতে শুনি-
‘শ্রান্ত বরষা অবেলার অবসরে,
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া,
স্বর্ণ সুযোগে লুকোচুরি-খেলা করে
গগনে গগনে পলাতক আলোছায়া।’ (শাশ্বতী)
বর্ষা যেন সঙ্গে করে নিয়ে যায় প্রকৃতির চঞ্চলতা, সজীবতা। বর্ষা যাপনের পর তাই বৃষ্টিহীন বিকেলবেলা নিরস মনে হয়। যেমনি মনে হয়েছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের –
‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বর্ষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।’ (আনন্দ-ভৈরবী)
কেবল বর্ষাই নয়, ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ছয়টি ঋতুই পৃথক বৈচিত্র্যের বার্তা নিয়ে আসে আমাদের সম্মুখে। আমরা মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই, গর্বিত হই। তবে প্রকৃতির ভয়াবহ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে অপূর্ব ও অমূল্য এই ঋতুবৈচিত্র্যকে আজ আমরা হারাতে বসেছি। আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ঋতুবৈচিত্র্যকে বাঁচানোর দায়ভার ও দায়িত্ব তাই আমাদেরই নিতে হবে।